গতকাল বৃহস্পতিবার মাগরিবের নামাজের পর থেকে ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলার আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবারের বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা। গতকাল তাবলিগ জামাতের শুরায়ে নিজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান গণমাধ্যমকে এই তথ্য জানান। আজ শুক্রবার বাদ ফজর বয়ান করবেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। আজ সকাল ১০টায় বিভিন্ন খিত্তায় খিত্তায় তালিমের আমল হবে।
এদিকে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা শুরুর একদিন আগেই টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরের ময়দান মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ময়দানের খিত্তায়-খিত্তায় জমায়েত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মুসলমানরা, এসেছেন বিদেশিরাও। তাবলিগ জামাতের দুটি পক্ষ মাওলানা জোবায়ের এবং মাওলানা সাদের মধ্যে বিভেদের কারণে গত কয়েক বছরে মত এবারও বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে দুই পর্বে। এর মধ্যে আজ শুক্রবার থেকে মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীদের অংশগ্রহণে শুরু হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এই পর্বটিও অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুই ধাপে। এ বিষয়ে মাওলানা জোবায়েরের পক্ষের মুরুব্বি প্রফেসর আব্দুস সালাম বলেন, ‘তাবলিগে আমাদের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি। মাঠে সবার স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণই এবার প্রথম পর্বের ইজতেমাকে দুই ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। আমাদের প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি এবং দ্বিতীয় ধাপ ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। তাদের প্রথম ধাপ ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি ও দ্বিতীয় ধাপ ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে যুবায়েরপন্থিদের দুই ধাপের ইজতেমা শেষ হবে।
আর দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা ১৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে বলে জানা গেছে। শুরায়ে নেজাম অনুসারী বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, তাবলিগের মেহনত একটি দ্বীনের অন্যতম মেহনত এবং দ্বীনের ধারক বাহক হচ্ছেন হযরত ওলামায়ে কেরাম। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইয়েরা উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে থেকেই তাবলিগের মেহনত করতে চান।
এই সংখ্যাটা এত ব্যাপক যে টঙ্গী মাঠের ১৬০ একর জায়গায় তাদের অবস্থান করাটা খুবই কষ্টদায়ক হয়ে যায়। গত কয়েক বছর শুরায়ে নেজামের অধীনে যে সব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছে, আপনারা জেনে থাকবেন আমাদের সাথীরা স্থায়ী টয়লেটের ছাদগুলোর উপরে, আশপাশে ছোট ছোট মাঠগুলোর ভেতরে এবং রাস্তায় ধুলাবালির ভেতর কষ্ট করে অবস্থান করেছেন। এবার দুই ধাপে ইজতেমা হওয়ার কারণে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে, ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরো বলেন, বুধবারের বিকাল থেকেই নজমের জামাতের সাথীরা ময়দানে চলে এসেছেন এবং দেশ-বিদেশের মেহমানরা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ময়দানে সমবেত হচ্ছেন। এর মধ্যে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের সিংহভাগই পূর্ণ হয়ে গেছে। ময়দানে উপস্থিতরা নিজ নিজ খিত্তায় সু-শৃঙ্খলভাবে অবস্থান নিয়ে তসবি পাঠসহ ধর্মীয় কাজ করে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তারা শীর্ষ মুরুব্বীদের বয়ান শুরুর অপেক্ষা করছেন। ইজতেমা ময়দানের আয়োজক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজ জানান, ইজতেমায় বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ১০ থেকে ২০ হাজার বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করছে আয়োজক কমিটি।
তিনি জানান, এই ধাপে ঢাকার একাংশসহ (মিরপুর, কাকরাইল, ডেমরা, দোহার, ধামরাই, নবাবগঞ্জ) মোট ৪১টি জেলার অনুসারীরা অংশগ্রহণ করছে। সেগুলো হচ্ছে- গাজীপুর, গাইবান্ধা, নাটোর, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, নড়াইল, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোণা, শেরপুর, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বি.বাড়িয়া, খুলনা, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, চাপাইনবাবগঞ্জ, পিরোজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, রাজবাড়ী জেলা। দ্বিতীয় ধাপে (৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি) অংশগ্রহণ করবেন অন্য জেলার তাবলিগের সাথীরা।
ময়দানে চলছে চূড়ান্ত পর্যায়ের টুকিটাকি কাজ : এর মধ্যেই তুরাগ নদীর তীরের ময়দানের বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তারপরও এখন চলছে চূড়ান্ত পর্যায়ের কিছু টুকিটাকি কাজ। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সরজমিনে ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে টিনের চালা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বিদেশি মেহমানদের থাকার জায়গা ও বয়ান মঞ্চ। এর পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ পাশের শামিয়ানা, শব্দ প্রতিধ্বনিরোধক বিশেষ ছাতা মাইক ও বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিবাসে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিফোন সংযোগসহ আধুনিক বিভিন্ন সুবিধাসমূহসহ সর্বাত্মক ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ময়দানের উত্তর-পূর্ব কোণের ঢাকার খিত্তা ও ২৯ নম্বর টয়লেট বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পাশ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত দীর্ঘ বেশ কিছু জায়গায় কোনো শামিয়ানা টাঙানো হয়নি।
এ বিষয়ে শুরায়ে নিজাম অনুসারী বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান সাংবাদিকদের জানান, ইজতেমা ময়দানের প্রায় ৯৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। মূল ময়দানে শামিয়ানা টাঙানোর কাজ যতটুকু হয়েছে আপাতত ততটুকুই। বাকি অংশে স্থানীয় এবং আশেপাশের জেলার অনুসারীরা নিজ নিজ খিত্তায় ত্রিপল বা অন্যান্য চট-কাপড়ের শামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এদিকে ময়দানে অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে ময়দানের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ব্রিজ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগ নদীতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা পাঁচটি পন্টুন সেতু নির্মাণ করেছেন।
এছাড়াও ফেরি ঘাটের জেটি দিয়ে অপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করেছেন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। বিআইডব্লিউটিএ’র সহকারী পরিচালক রেজওয়ান হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিশ্ব ইজতেমায় আগতদের তুরাগ নদী পারাপারের জন্য একটি পন্টুন সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।’ এরই মধ্যে যাবতীয় সব কিছু সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ময়দানের চারপাশের স্থাপিত বহুতল শৌচাগার ও পানি সরবরাহের লাইনগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা হয়েছে। ইজতেমার মাঠে আগতদের সুবিধার্থে খাবার পানি, অজুখানা, পুরানো টিউবওয়েল, বাথরুম ও কাঁচা পাকা টয়লেটও সংস্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য ইটের সলিং রাস্তা তৈরি ও পুরানো ভাঙাচোরা রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। ইজতেমা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ময়দানের চারপাশে পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন সাংবাদিকদের জানান, ময়দানে আগত মানুষদের আগমন ও স্থান সংকুলান করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান জানান, ইজতেমা উপলক্ষ্যে টঙ্গী ও আশেপাশের এলাকা জুড়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। বৃহস্পতিবার থেকেই পুলিশ, র্যাবসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এজন্য ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ টঙ্গীতে আনা হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাবের কন্ট্রোল রুম। ইজতেমা শুরুর দিন থেকেই হেলিকপ্টার আকাশপথে টহল থাকবে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিদেশি খিত্তাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত সংখ্যক সরকারি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা : বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে স্টেশন রোডসহ ময়দানের চারপাশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে অর্ধশত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। টঙ্গী ২৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালের পক্ষ থেকেও ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. আফজাল হোসেন বলেন, টঙ্গী হাসপাতালকে ইজতেমার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও একটি হৃদরোগ ইউনিট, একটি বক্ষব্যাধি ইউনিট, অ্যাজমা ইউনিট, ট্রমা ইউনিট, অর্থোপেডিক ইউনিট ও বার্ন ইউনিট, ১৫টি স্যানিটেশন টিম এবং ২৫টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।