মিয়ানমারের জান্তা সরকারের হত্যা ও নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছেন। বছরের পর বছর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এরমধ্যেই নতুন করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী জোরপূর্ব রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। যা দেশের ভেতরে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
গতকাল শুক্রবার বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ফেসবুক পোস্টে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার ও মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে হবে। বিষয়টিকে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করে এর দ্রুত সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারেক রহমান। বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছা-পূর্ণ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার ও মিয়ানমারের ওপর স্থায়ী চাপ সৃষ্টি করার জন্য আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি।’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকট-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই সংকট সমাধান থেকে এখনও অনেক দূরে।’ বিশ্বজুড়ে জোরপূর্বক ব্যস্তচ্যুত মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এই শরণার্থী সংকট শুধু একটি বৈশ্বিক উদ্বেগ নয়, বরং এটি বাস্তব জীবনের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা।’ বর্তমানে কক্সবাজারে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ, যা দেশের মানবিক প্রতিশ্রুতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তবে এটি বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ একটি সংকট হিসেবে রয়ে গেছে এবং এর বোঝা ক্রমশই এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যা বিপজ্জনকভাবে অস্থিতিশীল বলেও সতর্ক করেন তিনি। এ সময় শরণার্থীদের ঘরে ফেরানোর জন্য সবাইকে শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন ও অনুসরণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করারও আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর দারিদ্র্য, উন্নয়নঘাটতি ও সংঘাতের প্রভাব’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সভায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান না হলে দ্রুতই এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকির কারণ হতে পারে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বিগত আট বছরের বেশি সময় ধরে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এই সংকট এখন আর শুধু মানবিক বিষয় নয়; এটি অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং ক্রমবর্ধমানভাবে একটি নিরাপত্তা ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজ দেশ মিয়ানমারে নির্মম নির্যাতনের কারণে ব্যস্তচ্যুত এই জনগোষ্ঠীকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও অধিকারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। বহু রোহিঙ্গা ৯০’র দশকে কক্সবাজারে বসতি গড়ে। ২০১৬ পর্যন্ত তাদের সংখ্যা ছিল তিন লাখ। তখন পর্যন্ত অবস্থা জটিল ছিল না। কিন্তু ২০১৭ সালে নতুন করে সাত লাখেরও বেশি এসেছে। তখনই চাপটা বেড়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, এটি (রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া) ছিল মিয়ানমারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। তিনি বলেন, ভারত মুখে বলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আছে। কিন্তু তারাই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশইন করছে। ভালো ভূমিকা রেখেছে শুধু ওআইসি। তাই রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন বা ভারতের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো বাংলাদেশকে অন্তত বেশি সমর্থন দেবে আশা করি। রোহিঙ্গাদের জন্য তৃতীয় কোনো দেশ খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ভালো জায়গা। মালয়েশিয়া মিয়ানমার থেকে খুব বেশি দূরে না। রোহিঙ্গাদের সেদেশ থেকে ফেরত আসতেও সুবিধা হবে। আমাদের যেহেতু ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে, এটি আমাদের জন্য বড় সংকট। তাই থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার সঙ্গে নেগোশিয়েট করে যদি রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য অংশ সেসব দেশে পাঠানো যায় এটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ উভয় পক্ষের জন্যই ভালো। রোহিঙ্গাদের জন্য তৃতীয় দেশের বিষয়টি নিয়ে ভাবা খুব জরুরি। কারণ, প্রত্যাবাসনটা অনিশ্চিত। আবার দিন দিন কক্সবাজারে চাপ বাড়ছে। তাই আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে নেগোশিয়েট করে সেখানে রোহিঙ্গাদের পাঠানো যেতে পারে।
ভারতকে রোহিঙ্গা ঠেলে দেওয়া বন্ধের আহ্বান অ্যামনেস্টির : ভারতকে অবিলম্বে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। একই সঙ্গে মানবাধিকার সংস্থাটি ভারতকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সীমান্তে ঠেলে না দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ আহ্বান জানায়। আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসের একদিন আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ?‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। সংস্থাটি জানিয়েছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গত মাসেই অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে জোর করে মিয়ানমারের কাছে আন্তর্জাতিক জলসীমায় পরিত্যাক্ত অবস্থায় ফেলে আসে। এছাড়া পৃথক আরেকটি ঘটনায় কমপক্ষে ১০০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও জানায় অ্যামনেস্টি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল ভারত। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়া এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে জোরপূর্বক তাদেরকে বের করে দেওয়ার মতো সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ইতিহাস মনে রাখবে।
সংস্থাটি বলছে, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানের পর থেকে রোহিঙ্গারা তাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা এবং নিপীড়ন সহ্য করছে। এছাড়াও, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা খাদ্য, পর্যাপ্ত আশ্রয় এবং চিকিৎসার মতো প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে তীব্র সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সহায়তা কমার ফলে যা আরো তীব্র হয়েছে।
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট শুরু হওয়ার আট বছর পর, বাংলাদেশি স্থানীয় জনগণ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। পূর্ববর্তী গবেষণা দেখায় যে অনেক স্থানীয় মানুষ শত্রুতা বোধ করে এবং নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছে। গবেষণাটি সামাজিক সম্প্রীতি উন্নত করার একটি নতুন উপায় পরীক্ষা করে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দৌজা বলেন, শরণার্থী ও হোস্ট জনগোষ্ঠীর মধে?্য মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব থেকে চাপ কাজ করে। বাইরের লোককে ধারণ করার কোনো ঐতিহাসিক উদাহরণ নেই। বাইরে থেকে আসা মানুষকে আমরা হয়তো নানা পরিস্থিতিতে মেনে নেই কিন্তু অভিযোগ থাকে অনেক। আর রিফ্যুজির ক্ষেত্রে এলাকার যেকোনো নেতিবাচকতার জন?্য তাদের দায়ী করার প্রবণতা থাকে। দীর্ঘসময় শরণার্থী কোনো এলাকায় থাকলে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যায় এমন না।