ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রশাসনের ‘অদক্ষতায়’ কাটছে না সচিবালয়ের অচলাবস্থা

প্রশাসনের ‘অদক্ষতায়’ কাটছে না সচিবালয়ের অচলাবস্থা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আনসার, নকল নবিশ ও নার্সসহ বহুমুখী আন্দোলনে অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা চাপে পড়লেও তা সামলে নিয়েছে। অধিকাংশ আন্দোলন থেমে গেলেও প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরে কর্মরত কর্মচারীদের আন্দোলন থামছে না। সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সচিবালয়ে কর্মরত সরকারি কর্মচারীরা। এতে কাজের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর আন্দোলন চলা অবস্থায় সচিবালয়ের ভেতরে নতুন করে আরেকটি আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে। সচিবালয়ের ভেতরে ক্যান্টিন পরিচালনার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কর্মচারীদের দুই গ্রুপের মারামারি হয়েছে। এতে অন্তত পাঁচজন কর্মচারী আহত হয়েছেন।

জনপ্রশাসন বিশেজ্ঞরা বলছেন, সচিবালয়ের কর্মচারীদের এ আন্দোলন এক মাসে গড়াল। সারা দেশের প্রশাসনিক যত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড সবকিছু সচিবালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। সরকারের উপদেষ্টা, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবরা নিয়মিত সচিবালয়ে অফিস করেন। আর সেই সচিবালয়ের ভেতরে কর্মচারীদের টানা আন্দোলন কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারি কর্মচারীদের এই আন্দোলনের প্রভাব মাঠপর্যায়ের সরকারি অফিসগুলোয় পড়েছে। যতদ্রুত সম্ভব সরকারকে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে সচিবালয়ের ভেতরে এমন আন্দোলনের দৃশ্য দেখা যায়নি। কিন্তু বর্তমানে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ কেন্দ্র করে টানা আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনের সামনে সরকারি কর্মচারীরা থাকলেও পেছনে সরকারবিরোধী শক্তি খুশি হচ্ছেন। সরকারবিরোধীরা সচিবালয়ের ভেতরে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে প্রশাসনে অস্থিরতার চেষ্টা করছে।

সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, অধ্যাদেশ জারি করার পেছনে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্বলতা ও দক্ষতার অভাব আছে। তাদের কৌশল ভুলপথে এগিয়েছে। যার কারণে অধ্যাদেশ জারির পর সচিবালয়ের ভেতরে আন্দোলনে নেমেছেন কর্মচারীরা। বাংলাদেশের মতো দেশে এই অধ্যাদেশ কল্পনার বাইরে। এখন অধ্যাদেশটি হাস্যকরে পরিণত হয়েছে। কারণ সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এর ৪২ ধারার (২) বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অনূর্ধ্ব ১ (এক) বৎসর মেয়াদের কোনো কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হইলে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাহাকে নিম্নবর্ণিত যে কোনো দণ্ড আরোপ করিতে পারিবে, যথা: (ক) তিরস্কার (খ) নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ (গ) নিম্নপদ বা নিম্নতর বেতন স্কেলে অবনমিতকরণ; অথবা (ঘ) কোনো আইন বা সরকারি আদেশ অমান্যকরণ অথবা কর্তব্যে ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে সরকারি অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতি সংঘটিত হইলে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায়। এবার নতুন অধ্যাদেশে দপ্তরের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার অবাধ্য কিংবা অফিসে অনুপস্থিত থাকলে চাকরি চলে যাবে, এটি হাস্যকর। অধ্যাদেশটি জারির পেছনে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতা রয়েছে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া।

তিনি আরও বলেন, অধ্যাদেশ জারির পরেও সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন। এখানেই বোঝা যাচ্ছে, প্রশাসনের ঊধ্বর্তন পর্যায়ে অযোগ্যতার কারণে আন্দোলন চলমান আছে।

জানা গেছে, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-কে কালাকানুন উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবিতে মাসব্যাপী বিক্ষোভ, কর্মবিরতি ও স্মারকলিপি দেওয়ার মতো কর্মসূচি পালন করছে সচিবালয় কর্মচারী ঐক্যপরিষদ। তাদের চলা আন্দোলনের মধ্যে ২৫ মে অধ্যাদেশটির গেজেট প্রকাশ করে সরকার। নতুন কর্মসূচি অনুযায়ী, অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করছেন সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। সরকার কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে অধ্যাদেশটি করেনি বলে উল্লেখ করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সরকার গঠিত কমিটির প্রধান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, তার কাছে মনে হয়েছে, অবশ্যই কিছু কিছু জায়গায় অধ্যাদেশটির পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে পর্যালোচনা কমিটি বৈঠক হয়েছে।

অধ্যাদেশে যা আছে : অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো- সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যে কোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যে কোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন। অধ্যাদেশে এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি হতে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা যাবে। বর্তমানে দেশে ১৫ লাখের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। আইন অনুযায়ী সবাই কর্মচারী।

কর্মচারী অধ্যাদেশের বিষয়ে গত বুধবার সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, সচিবালয়ে কর্মচারীরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে সামনের দিনগুলোতে আন্দোলন চলবে। তবে, অধ্যাদেশ সংশোধনে আমাদের কাঙ্ক্ষিত দাবি বাস্তবায়ন হলে, সেটি নিয়ে আমাদের ঐক্য ফোরামে নেতৃবিন্দু বসে আলাপ-আলোচনা করবেন, যেটা বাস্তবসম্মত সেদিকে আমরা অগ্রসর হবো।

তিনি আরও বলেন, নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির কারণে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে ব্যাঘাত ঘটবে না। কর্মচারীদের দুই অংশ নিয়ে আন্দোলনে গঠিত বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কার্যক্রমও চলমান থাকবে। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন মো. বাদিউল কবীর ও নিজাম উদ্দিন আহমেদ এবং অন্য অংশের নেতৃত্বে মো. নূরুল ইসলাম ও মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম। চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলনে দুটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠন করা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতৃত্বে।

সংবাদ সম্মেলনে বাদিউল কবীর বলেন, একপক্ষ আইন অমান্য করে তালা ভেঙে সমবায় সমিতির অফিস দখল করেছে। এ নিয়ে কয়েকজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এতে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলন ব্যাহত হবে না, ঐক্য ফোরামের কার্যক্রম চলবে। এক পক্ষ স্বাভাবিক পন্থায় দায়িত্ব গ্রহণ না করে, তারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে সচিবালয়ে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় ও ভাতৃত্বপূর্ণ কর্মপরিবেশ, সেই ঐতিহ্য নষ্ট করেছেন।

সমবায় সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালনা কমিটির বিষয়ে আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তারা উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সেখানে অবস্থান করেছেন। আমি দুপক্ষকেই সংযত হতে বলি। আমার পক্ষে যারা ছিলেন তারা আমার অনুরোধ রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তাদেরও অনেকে আমার কথা অনুসরণ করে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সেটা হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এটি অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতি সচিবালয়ের ভেতরে দুটি ক্যান্টিন এবং ওএমএসের একটি দোকান পরিচালনা করে। ২০২৩ সালের মার্চে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি পায় এই সমবায় সমিতি। কোরবানির ঈদের আগ পর্যন্ত এই কমিটি সচিবালয়ের ক্যানটিন পরিচালনা করছিল। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে সচিবালয়ে ক্যানটিন পরিচালনার দখল নিয়ে মারামারি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি নূরুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ কয়েকজন আহত হন। নূরুল ইসলাম ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যানও বটে। বাদিউল কবীরের গ্রুপের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছে নূরুল ইসলাম গ্রুপ।

সূত্র জানায়, গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর কর্মচারীদের এক পক্ষ ক্যানটিন দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষ বিবাদে জড়ালে ঢাকা বিভাগীয় সমবায় কার্যালয় গত ৩ জুন ১১ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি করে দেয়। ওই কমিটির লোকজন গত ১৯ জুন সমবায় সমিতির তালা ভেঙে কার্যালয়ের দখল নেন। এরমধ্যে গত ১৯ জুন সমবায় সমিতির বর্তমান কমিটি রিট পিটিশন দায়ের করলে উচ্চ আদালত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।

সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যারা এখন সমবায় সমিতির দখল নিয়েছেন আমরা তাদের আদালতের রায়ের কপি দেই। কিন্তু তারা সেই কপি গ্রহণ করেননি। এরপর আমরা বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিতভাবে জানাই। বিষয়টি সমাধান করে দেওয়ার জন্য সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনের নেতাদেরও অবহিত করি। সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের কমিটির মেয়াদ থাকলেও গত ১৯ জুন সমিতির কার্যালয়ে তালা লাগায় একটি পক্ষ। এরপর দায়িত্ব হস্তান্তর ছাড়াই ক্যান্টিন পরিচালনা করে তারা। ১৯ জুন শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত