আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না, বরং আরও বাড়ছে। কবে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন- এই প্রশ্নের এখনও স্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একসময় বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হবে। পরে তিনি বলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। সবশেষে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠক করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সংস্কার ও বিচার কাজের অগ্রগতি হলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। অর্থাৎ আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে ঐকমত্য নেই। একাংশের মধ্যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও যেমন রয়েছে, তেমনি অন্য অংশের নেতারা এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও সময় নিতে বলছেন। দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে কিছু দল। নতুন ও ছোট দলগুলো দেরিতে নির্বাচনের পক্ষে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এ বিষয়ে বিভক্ত। এক পক্ষ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজই হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন তা করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। অন্য পক্ষ বলছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের দোসরদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। রাষ্ট্রের সংস্কারও সম্পন্ন করতে হবে। আবার কারও মত, গণহত্যার বিচার ও সংস্কারকে নির্বাচনের বিপরীতে দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার অবস্থান থেকে সুবিধামতো প্রস্তাব রাখছে। এই অবস্থার অবসান অন্তর্বর্তী সরকারকেই করতে হবে। বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোর বাইরে নতুন এবং ছোট দলগুলো মনে করছে, দ্রুত নির্বাচন তাদের জন্য সুবিধাজনক হবে না। আর বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো মনে করছে, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব করা হচ্ছে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন রমজানের আগে ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে কিনা এখনই বলা মুশকিল। বরং ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে দিনদিন ধোঁয়াশা আরও বাড়ছে।
সূত্রমতে, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) আকস্মিক বৈঠকে এ আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। কানাঘুষা চলছে, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিষয়টি শিগগির জনগণের সামনে স্পষ্ট হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও এ বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্কার এবং নির্বাচন ইস্যুতে এমন বৈঠক আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠক করেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে অনেকটাই আকস্মিক এ বৈঠক সম্পর্কে গণমাধ্যমকে কোনো পক্ষ থেকেই ব্রিফ করা হয়নি।
লন্ডন বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছিলেন, ‘সঠিক তারিখ নির্ধারণে আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন কমিশন শিগগির একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’ এরপর রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচন কমিশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ অবশ্য নির্বাচন কমিশনকে সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ারও পরামর্শ দেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দলের নেতাদের বিভিন্ন সভায় সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে জোরালো বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশনও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সংকেতের দিকে তাকিয়ে আছে। গত ১৫ জুন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ দপ্তরে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। সরকারের সঙ্গে আলোচনা হলে ইসি সরকারের ভাব বুঝতে পারবে। তখন নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ বৈঠককে লন্ডন বৈঠকের পরবর্তী ফলোআপ বৈঠক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বৈঠকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এবং সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকতে পারে। ফলে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আরও একধাপ অগ্রগতি আসতে পারে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উদ্দীনের বৈঠকের বিষয়গুলো জনগণের সামনে স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিএনপির ধারণা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসি। বিএনপি মনে করছে নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তুতি সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নেওয়া সম্ভব।’ তিনি বলেন, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা হয়তো তার ম্যাসেজ সিইসিকে জানিয়েছেন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে প্রস্তুতি নিতে। এটি আমাদের ধারণা। উভয় পক্ষ থেকে বার্তা এলে সেটি স্পষ্ট হবে।’ অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে বলে এসময় আশাবাদ ব্যক্ত করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সব দলই একমত। যদি তাই হয়, তবে এই ঘোষিত সময়ের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা অসম্ভব।’ স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের জন্যই এত দিনের সংগ্রাম, স্থানীয় নির্বাচনের জন্য না। ইসির প্রধান কাজ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া আগামী নির্বাচন দেশের মানুষ মানবে না। এ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঐক্য তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দৃশ্যমান সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। যারা বলেন ক্ষমতায় গেলে সংস্কার করবেন, তারা কীভাবে বুঝলেন তারা ক্ষমতায় যাবেন?’ গতকাল শনিবার ইসলামী আন্দোলন আয়োজিত মহাসমাবেশে আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কিছু আচরণ জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। নির্বাচনের আগে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও আজকে আমরা এক হয়েছি। এর মাধ্যমে ইসলামের ঐক্যের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। পীর চরমোনাইয়ের এ উদ্যোগ ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’ জামায়াত নেতা এারা বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেবো না। খুনিদের দৃশ্যমান বিচার নিশ্চিত করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই ঘোষণা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারের ভেতরে কোনো ফ্যাসিবাদী থাকতে দেওয়া হবে না।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। যে যত শতাংশ ভোট পাবে তাদের তত শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এটা এখন জনগণের দাবি, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি।’ এসময় তিনি বিএনপিকেও পিআর সিস্টেমে নির্বাচনে আসা উচিত বলে মত দেন। রেজাউল করীম বলেন, ‘জুলাই অদ্ভ্যুত্থানের পর সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কার নিয়ে এখন দ্বিতীয় দফা আলোচনা চলছে। আমরা দেখছি মৌলিক সংস্কারে কেউ কেউ আপত্তি করছেন। এটা দ্বিমুখিতা। সংস্কার না হলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর পাশাপাশি দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দল নিয়ে ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চলছে, এই ঐক্য গড়তে পারলে আগামী দিনে আমাদের হাতেই আসবে রাষ্ট্রক্ষমতা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশে যোগ দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন যেন পিআর পদ্ধতিতে হয়, সেই দাবি নিয়ে জোরেজোরে জাগতে হবে। তিনি বলেন, দেশ ও জনগণের জন্য প্রয়োজনে তারা আবারও লড়াইয়ে নামবেন। এসময় তিনি আগামীর বাংলাদেশের প্রশ্নে খুনিদের বিচার ও সংষ্কারের প্রশ্নে সকল মতের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুরোধ জানান।
একজন রাজনীতি বিশ্লেষকের মতে, নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কিছুতেই কাটছে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ আন্তরিক কি না, সে প্রশ্ন যেমন রয়েছে; তেমনি সংস্কার ও বিচার প্রসঙ্গ সামনে এনে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বিচার প্রসঙ্গে বলতে হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিচারকাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। বিচার কবে শেষ হবে, তা আইনি প্রক্রিয়া এবং ট্রাইব্যুনালের বিচার্য বিষয়। তবু তো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কী? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, সাড়ে দশ মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর জনপ্রশাসন, পুলিশ কোনো ক্ষেত্রে একটি সংস্কারও সরকার করতে পারেনি। লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্বাচনের সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধের কথা বলা হয়েছে। এ সময় হিসাবে ধরে নিলে এখনও নির্বাচনের সাড়ে সাত মাস বাকি। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে অন্তর্বর্তী সরকার কী করবে আর কী করতে চায়?
ওই রাজনীতি বিশ্লেষকের মতে, সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, সংবিধান, নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, উচ্চকক্ষ গঠন, নারী আসন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। আর এজন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ চালু রেখেছে। বেশ কিছু বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও আবার বেশ কিছু বিষয়ে এখন পর্যন্ত সমঝোতা থেকে অনেক দূরেই অবস্থান করছে। এছাড়া নানা কারণে প্রশ্ন উঠছে, সরকারের কোনো অংশ এবং বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল কি নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে? আর এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় থাকা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।