সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে আন্দোলনের গতিবেগ পাল্টাতে থাকে। সামনের দিকে দিন যতই গড়ায় আন্দোলনের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। সেই আন্দোলন দমাতে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর অবস্থানে গেলেও বিন্দুমাত্র পিছু হটেনি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের চলমান আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে চলমান এই আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৩ জুলাই উত্তাল হয়ে উঠে দেশের শিক্ষাঙ্গন।
এ দিন রাজধানীর শাহবাগে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির পক্ষে ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আঠারোর পরিপত্র-পুনর্বহাল করতে হবে’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক-মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘ছাত্রসমাজ গড়বে দেশ, মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাই নাই’ ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘হাইকোর্ট না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’ ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। ¯ে¬াগানের ফাঁকে প্রতিবাদী গানও পরিবেশন করা হয়, পাশাপাশি চলে বক্তব্যও।
ওই সময়ে আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের পর থেকে কোটা বাতিল দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেন।
শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল করে তা আইনে পরিণত করাসহ চার দফা দাবি জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি থেকে বেলা ১১টায় সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। পাশাপাশি কোটা পদ্ধতি বহালের দাবিতে দু-এক জায়গায় কর্মসূচি পালিত হয়।
রাজধানীর শাহবাগে সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী। দুপুর থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত সাত কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিকেল সাড়ে ৩টায় শাহবাগ অবরোধ করেন। এ সময় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থানের পর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রাজু ভাস্কর্যে এসে কর্মসূচি শেষ হয়। অবরোধকালে শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী স্লোগান, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন ও গান পরিবেশন করেন। শাহবাগের অবরোধস্থলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হয়েও কোটা বাতিলের দাবি তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ফারাবি রহমান শ্রাবণ। তিনি বলেন, ‘আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি। সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা যৌক্তিক হতে পারে না। ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কী করবে।’
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের সমবেত হন তারা। অবরোধে জাবির প্রধান ফটক থেকে সাভারের হেমায়েতপুর ও ডেইরি গেট থেকে নবীনগর পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। রাজধানীর তাঁতীবাজারে সড়ক অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে প্রায় ৪০ মিনিট যান চলাচল বন্ধ ছিল। চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সোহান বলেন, সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হোক। মেহেরুন্নেসা হিমু বলেন, চাকরির বাজারে মেধার মূল্যয়ন না হওয়া অশনিসংকেত। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলেন, চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করার সিদ্ধান্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসনের নামান্তর। একই দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল ছিল রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগের দাবিতে শতাধিক শিক্ষার্থী আগারগাঁও-খামারবাড়ি সড়ক অবরোধ করেন। তারা ‘সারাবাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘দেশের মেধা দেশে থাক, কোটা প্রথা নিপাত যাক’ স্লোগান দেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসসংলগ্ন বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক তিন ঘণ্টা অবরোধ করেন। তারা কোটা প্রথা বাতিল করে চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগের দাবি জানানো হয়। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে পদযাত্রা বের করে সমাবেশ করেন। এতে শত শত শিক্ষার্থী অংশ নেন। এ দিন ময়মনসিংহে ট্রেন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘আমার দেশ আমার মা, বৈষম্য মানি না’, ‘কোটা বৈষম্য দূর কর, নইলে বুকে গুলি কর’, ‘সারা বাংলা খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ইত্যাদি ¯ে¬াগান দেন। পরে তারা আগারগাঁও-খামারবাড়ি সড়ক অবরোধ করেন। ৩ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করেন। বেলা পৌনে একটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট এলাকায় অবরোধ শুরু হয়। চলে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।