মসজিদে হারাম : ইসলামের সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান মসজিদে হারাম। এটি পবিত্র কাবাঘর ঘিরে অবস্থিত। সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা শহরে এর অবস্থান। কাবার দিকে মুখ করে মুসলমানরা নামাজে দাঁড়ান। কাবাঘরের চারদিকে অবস্থিত তাওয়াফের স্থানকে ‘মাতাফ’ বা চত্বর বলা হয়। কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্বকোণে মাতাফ (তাওয়াফের জায়গা) থেকে দেড় মিটার ওপরে হাজরে আসওয়াদ। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ (কাবা শরিফ সাতবার চক্কর দেওয়া) শুরুর স্থান। প্রতিবার চক্কর দেওয়ার সময় এ হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতে হয়। ভিড়ের কারণে না পারলে চুমুর ইশারা করলেও চলে। এটিই নিয়ম। কাবা শরিফের পাশেই আছে ক্রিস্টালের একটা বাক্স। চারদিকে যার লোহার বেষ্টনী। ভেতরে বর্গাকৃতির একটি পাথর। পাথরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান। প্রায় এক হাত। এ পাথরটিই মাকামে ইবরাহিম। মাকাম শব্দের অর্থ দাঁড়ানোর স্থান। অর্থাৎ ইবরাহিম (আ.)-এর দাঁড়ানোর স্থান। তিনি এর ওপর দাঁড়িয়ে কাবা শরিফ নির্মাণ করেছেন। ইবরাহিম (আ.)-এর অলৌকিকতার কারণে শক্ত পাথরটি ভিজে তাতে তার পায়ের দাগ বসে যায়। আজও সেই ছাপ রয়েছে। বাইতুল্লাহর উত্তর দিকের ছাদে (হাতিমের মাঝ বরাবর) যে নালা বসানো, তাকে ‘মিজাবে রহমত’ বলা হয়। এ নালা দিয়ে ছাদের বৃষ্টির পানি পড়ে। কাবাঘরের উত্তরদিকে অর্ধবৃত্তাকার উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একটি স্থান আছে। একে বলা হয় ‘হাতিম’। দুনিয়াতে আল্লাহতায়ালার যত অনুপম নিদর্শন আছে, এর মধ্যে ‘জমজম কূপ’ অন্যতম। জমজম কূপের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। এ কূপের পানি সর্বাধিক স্বচ্ছ, উৎকৃষ্ট, পবিত্র ও বরকতময়। এ পানি শুধু পিপাসাই মেটায় না, ক্ষুধাও নিবৃত্ত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জমজমের পানি হলো পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ পানি। এতে রয়েছে তৃপ্তির খাদ্য ও ব্যাধির আরোগ্য।’ (জামে কাবির : ১১০০৪)।
মসজিদে নববি : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার এ মসজিদে এক নামাজ পড়া মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে এক হাজার নামাজ পড়ার চেয়েও উত্তম।’ (বোখারি : ১১৯০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন এ শহরটির নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের পরপরই ইয়াসরিব নামটি পবির্তন করে মদিনা নামকরণ করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো মসজিদ ছিল না। নতুন হিজরতকারীদের মধ্যে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের শূন্যতা দেখা দিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন; যা মসজিদে নববি হিসেবে পরিচিত। মসজিদে নববি মুসলমান শাসকদের দ্বারা বহুবার সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে মসজিদে নববির গম্বুজ রঙের আস্তরণ দিয়ে সবুজ গম্বুজ বানিয়ে ছিলেন ওসমানি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মসজিদে নববির ওপর আলোকিত এ সবুজ গম্বুজটি কোটি কোটি ঈমানদারদের মাঝে আলোকবর্তিকা ও প্রাণস্পন্দন হয়ে আছে। যা কেয়ামত পর্যন্ত ঈমানি চেতনা দান করবে নবীপ্রেমিকদের অন্তরে। মসজিদে নববির রওজার দু’পাশে রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় সাহাবি ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক (রা.)-এর রওজা।
সাফা-মারওয়া : সাফা-মারওয়া মক্কায় অবস্থিত প্রসিদ্ধ দুটি পাহাড়। সাফা-মারওয়া, হাজেরা, ইবরাহিম ও শিশু ইসমাইল (আ.) এ নামগুলো একই সুতোয় গাঁথা। হজ ও ওমরার সঙ্গে পাহাড় দুটির নিবিড় সম্পর্ক। হজ ও ওমরার অংশ হিসেবে দুই পাহাড়ের মাঝে সাতবার আসা-যাওয়া করতে হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন। সুতরাং যারা কাবাঘরে হজ বা ওমরা পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকির কাজ করে, তবে আল্লাহ অবশ্যই তা জানবেন। তার সে আমলের সঠিক মূল্য দেবেন।’ (সুরা বাকারা : ১২৮)। একসময় মক্কানগরীতে কোনো বসতি ছিল না। চারপাশে শুধু মরুভূমি ছিল। বালুর এ বিশাল সাগরে কোথাও কোনো মানুষের আনাগোনা ছিল না। তখন আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ইসমাইলকে সেখানে রেখে আসেন। তখন স্ত্রী ইবরাহিম (আ.)-কে বলেন, ‘আপনি আমাদের কার কাছে রেখে যাচ্ছেন?’ ইবরাহিম (আ.) বললেন, ‘আল্লাহর কাছে।’ হাজেরা বললেন, ‘আমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।’ হাজেরার কাছে অল্প কিছু খাবার ও পানি ছিল। যখন খাবার ও পানি শেষ হলো, কাঠফাটা রোদ, উত্তপ্ত বালুকণা আর তৃষ্ণার্ত ইসমাইলকে দেখে হাজেরা ব্যাকুল হয়ে যান। শিশুপুত্রের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য দিগি¦দিক ছুটে বেড়ান। একবার সাফা পাহাড়ে আরোহণ করেন, আবার সেখান থেকে নেমে আসেন। ফিরে দেখেন নিজের কলিজার টুকরা শিশু এখনও বেঁচে আছে কিনা। ঢালুতে এসে কলিজার টুকরা চোখের আড়াল হয়ে যেত। তাই দৌড়ে পার হতেন। আর আরোহণ করেন মারওয়ায়। এভাবে সাতবার দৌড়ান। মহান আল্লাহর কাছে হাজেরার এ কাজ এতটাই পছন্দ হলো, উম্মতে মুহাম্মদির জন্য তা অবধারিত করে দিলেন।
আরাফা : মক্কা থেকে ১৫ মাইল আগে তায়েফের পথে অবস্থিত এক মরু ময়দান আরাফা। ময়দানের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত জাবালে রহমত। আরাফা শব্দের অর্থ পরিচিতি। আদম ও হাওয়া (আ.) আল্লাহর নির্দেশে জান্নাত থেকে বের হওয়ার পর পৃথিবীতে পরস্পরকে খুঁজতে খুঁজতে আরাফার ময়দানে এসে মিলিত হন। এ কারণে ওই স্থানের নাম আরাফা। আল্লাহ তার বান্দাদের গোনাহমুক্ত হওয়ার জন্য যেসব দিবস দিয়েছেন, আরাফার দিন তার অন্যতম। জিলহজ মাসের ৯ তারিখকে বলা হয় ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন। আরাফার দিবস অত্যন্ত মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ। আরাফার ময়দান ক্ষমা পাওয়ার ময়দান হিসেবেও পরিচিত। শূন্য মাথায় সেলাইবিহীন কাপড় পরা লাখো আল্লাহপ্রেমীর কান্নার শব্দে এদিন আকাশ-বাতাস প্রতিধ্বনিত হয়। চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে আল্লাহর কাছে কাতর হয়ে দোয়া করেন। দশম হিজরিতে এ ময়দানে রাসুলুল্লাহ (সা.) হজ উপলক্ষে তার শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে যা বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। আরাফার ময়দানে অবস্থান করাই হলো হজ। আরাফার দিনটি মূলত হজের দিন। আরাফা দিবসে বান্দার দিকে আল্লাহর রহমতের জোয়ার প্রবলবেগে উৎসারিত হয়। এ দিনে অসংখ্য বান্দাকে তিনি ক্ষমা করেন।
মিনা : পবিত্র মক্কা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে মিনা প্রান্তর। ৮ জিলহজ জোহর থেকে আরাফার দিন ফজর পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করেন হাজিরা। মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। এখানে হজ পালনকারীরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। মিনা প্রান্তরে অবস্থিত প্রায় লক্ষাধিক তাঁবুতে অবস্থান করেন হাজিরা। মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা হাজিদের জন্য ওয়াজিব। এ কাজটি যথাযথভাবে আদায় করতে না পারলে বা কোনো কারণে ছুটে গেলে হজ পালনকারীকে কাফফারা হিসেবে কোরবানি দিতে হয়। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের কাজটি মূলত ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসরণে প্রতীকী আমল হিসেবে করা হয়। ইবরাহিম (আ.) যখন স্বপ্নযোগে আদেশ পেলেন তার প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর জন্য কোরবানি করতে, তখন তিনি কয়েকবার উট কোরবানি করলেন। এরপরও তাকে স্বপ্নে কোরবানির আদেশ দেয়া হলো। তিনি বুঝতে পারলেন, তার সন্তান ইসমাইলের কথা বলা হচ্ছে।
কারণ, তখন তার কাছে ইসমাইলের চেয়ে প্রিয় আর কিছু ছিল না। তিনি ছেলেকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হলেন। তাকে কোরবানি করতে মিনায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় শয়তান তাকে বিপথে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত হলো। সে মিনার তিনটি জায়গায় ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-কে কুমন্ত্রণা দিল। তাদের মহান রবের আদেশ পালন থেকে বিরত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কুমন্ত্রণার বিপরীতে তিনি সেই তিন জায়গা থেকে পাথর নিক্ষেপ করে শয়তানকে বিতাড়িত করেন। এ মিনা প্রান্তরেই তিনি ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির জন্য শুইয়েছিলেন। ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত সেই ঘটনাকে চির জাগ্রত রাখার জন্য কঙ্কর নিক্ষেপকে হজের বিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইবরাহিম (আ.)-এর পাথর নিক্ষেপের ঘটনা এবং বর্তমানে হাজিদের প্রতীকী পাথর নিক্ষেপের কারণেই মিনাপ্রান্তর বিখ্যাত।
মুজদালিফা : হজের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে ৯ জিলহজ রাত ও ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। মুজদালিফায় অবস্থান প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা আরাফা থেকে ফিরবে, তখন অল্লাহকে স্মরণ কর (মাশআরুল হারামে) মুজদালিফায়। স্মরণ কর যেভাবে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা তো এর আগে পথভ্রষ্ট ছিলে।’ (সুরা বাকারা : ১৯৮)। আরাফার ময়দান ছেড়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার পার করার পর মুজদালিফা। তারপর ওয়াদিয়ে মুহাসসার। এরপরে মিনা। ওয়াদিয়ে মুহাসসার (হস্তিবাহিনীর ধ্বংসের স্থান) ছাড়া পুরো মুজদালিফা এলাকায় অবস্থান করা যায়।