ঢাকা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বালু সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত যমুনেশ্বরীর বুক

বালু সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত যমুনেশ্বরীর বুক

রংপুরের বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুরের উপর দিয়ে বয়ে চলা যমুনেশ্বরী নদীর অন্তত ২১টি পয়েন্টে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু লুট করছে বালু সন্ত্রাসীরা। প্রশাসনের লোক দেখানো অভিযানে তাদের কিছুই হয়না। দিনরাত ড্রেজার মেশিন দিয়ে যমুনেশ্বরীর বুক ক্ষতবিক্ষত করে তোলা হচ্ছে বালু। সরকার পরিবর্তনের আগে আওয়ামী লীগ কর্মীরা একচ্ছত্রভাবে বালুর পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন তাদের সাথে যোগ দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। অভিযোগ এসব বালুর পয়েন্ট দেখেও না দেখার ভান করার জন্য পুলিশকে দেয়া হয় মাসোহারা। বদরগঞ্জ উপজেলার নাগেরহাটে যমুনেশ্বরী নদীর উপর দিয়ে নির্মিত সেতুর দুইপাশে ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু উত্তোলন। উজান ও ভাটিতে একশ মিটারের মধ্যে দুটি মেশিন দিয়ে বালু তুলে সেতুটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। সেতুটির দুইপাশের ৬ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তুত ৮টি পয়েন্ট থেকে তোলা হয় বালু। দিনের আলোয় নদী ধ্বংসের এমন কর্মকান্ড চললেও প্রশাসন এসব বালুখেকোদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০, এর ৪ এর (খ) ধারায় বলা হয়েছে, সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু বা মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। অথচ এই সেতুর উজান ও ভাটিতে ১০০ মিটারের মধ্যে দুটি পয়েন্ট থেকে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে দিনরাত বালু তুলছে বালুখেকোরা। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলায় ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে দেদারসে বালু তোলা হচ্ছে। শ্রমিকরা বালু তোলার কাজে খুব দ্রুত সময় পার করছেন। সেগুলো সাথে সাথে ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বালু তোলার জায়গাগুলোতে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য ছোট বড় গর্ত। এ কারণে নদীপাড়ের অনেক জমি ভেঙে গিয়েছে। প্রত্যেকটি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে বালু সিন্ডিকেটের অন্তত ৮-১০ জন করে সদস্য। সাংবাদিক পরিচয় জেনে একজন বলেন, ‘বালু তুলতে দেয়না, বালু তুলেও খুব বেশি লাভ হয় না। চারপাশ ম্যানেজ করতে খরচ হয়’। স্থানীয়রা জানায়, এই এলাকার আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা অন্তত ২০০ জন নদীর বালু চুরিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। এই এলাকাতে সবচাইতে বেশি বালুর পয়েন্ট। প্রকৃতি-পরিবেশ বাঁচাতে এদের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের হুমকির মুখে পড়তে হয়। অনেক কৃষকের জমি নদীতে ভেঙে গেলেও তারা প্রতিবাদ জানাতে পারেনা। তাদের অভিযোগ, এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন। পুলিশ চাপ দিলেও দুই একদিন বন্ধ রেখে পরে আবার চালু করে। যেগুলো পয়েন্ট দিনে বন্ধ থাকে সেগুলো থেকে রাতভর বালু তোলা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশ ও প্রশাসনের কিছু লোক জড়িত।

বালু তোলায় গর্ত হয়ে নদীতে জমি ভেঙে গিয়েছে এই এলাকার কৃষক সাখাওয়াত হোসেনের। তিনি বলেন,নদী থেকে বালু তুলে সেখানে গর্ত হয়ে ৭ কাঠা জমি নদীতে ভেঙে গেছে। ওদের নিষেধ করলেও কারও কথা শোনে না। আওয়ামী লীগের আমলে এরা খুব অত্যাচার করেছে। এখনো নদী থেকে বালু তোলা বন্ধ করেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বলেন, ‘পুলিশ চাইলে সব পারে কিন্তু করে না। এদের সাথে বসে পুলিশ চা খায়। টাকা নিয়ে যায়। অভিযানের আগে ওরাই এদের সতর্ক করে দেয়। এই বালু তোলা কোনদিন বন্ধ হবে না’।

এই নদী থেকে সবচেয়ে বেশি বালু তোলা হয় উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকার আশপাশের ৮টি পয়েন্টে বালু সিন্ডিকেট চালাতেন ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি চয়ন মোহন্ত। বালুর পয়েন্টের দেখভাল ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করতেন তিনি কিন্তু পট পরিবর্তনের পর তার দায়িত্বে এসেছে ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি অহিদুল হক।

তার নেতৃত্বে সেতুর পশ্চিম প্সহের পয়েন্ট, দালালপাড়া ও শিংপাড়ায় তিনটি পয়েন্ট চলে। একটিতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বাবু সিংয়ের ছেলে নয়ন সিং অন্যটিতে আওয়ামী লীগ নেতা ফোকলা জামান দেখাশোনা করেন। সেতুর পূর্বপাশের পয়েন্টটি থেকে বালু তুলছেন ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মো. সোহাগ। তার সাথে আজহারুল ও আলিম নামের আ.লীগ ও জাতীয় পার্টির দুজন আছেন। দালালপাড়া পয়েন্ট থেকে বালু তোলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতিয়ার রহমান দুলুর শ্যালক লারজু ও তার ছেলে নাহিদ।

নাটারাম এলাকায় একটি পয়েন্ট থেকে বালু তুলতেন ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি তাজমুল ইসলাম ও সহ-সভাপতি শাকিল মিয়াসহ কয়েকজন। কিন্তু পুলিশের চাপে তারা কয়েকদিন আগে বালু তোলা বন্ধ করেন। নাটারাম থেকে দিলালপুর পর্যন্তু ৬টি পয়েন্টের মধ্যে মোস্তফাপুর বারোবিঘায় দুইটি পয়েন্ট চালান ছাত্রদলকর্মী বাবু ও তারসাথে রায়হানসহ কয়েকজন জড়িত। কাশিগঞ্জ মৌলভীপাড়া পয়েন্ট থেকে বালু তোলেন ইটভাটা ব্যবসায়ী মোয়াজ্জেম। এছাড়া চম্পাতলী ও কালীরঘাটের পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করেন আশরাফুল, বাবু, তাহের, মোস্তাকিম ও মিলনসহ কয়েকজন। এরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। এছাড়া দিলালপুর বালুর পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের রাধানগর ইউনিয়ন সভাপতি মোকসেদুল হক ও কর্মী বাচ্চু।

এছাড়া মিঠাপুকুর উপজেলার ১০নং বালুয়া মাসিমপুর বড়বালা ইউনিয়নে এ নদীর ৫ টি পয়েন্টে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এগুলো হলো- উঁচা বালুয়া, বালুয়া ব্রিজের নিচে, আটপুনিয়া, আটপুনিয়া বাগান বাড়ি ও রঘুনাথপুর। বালুয়া ব্রিজের নিচে বিষুপদ ও বাবুল মিয়া, আটপুনিয়ায় জুয়েল মেম্বার, আটপুনিয়া বাগানবাড়িতে জুয়েল, হুয়েল ও মিজানুর রহমান মিজু এবং রঘুনাথপুরে স্থানীয় ট্রাক্টর মালিকেরা বালু উত্তোলন করছেন।

বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত কুতুবপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি সোহাগ বলেন, ‘আমাদের দুই তিনটা ছেলে মিলে একটি পয়েন্ট করেছে। ওরা ১৭ বছর থেকে নির্যাতিত-নিপীড়িত।এদের নাম বাদ দিয়ে নিউজ করেন’।

এদিকে গত ১৬ জানুয়ারি বিভিন্ন নদ-নদী থেকে পাম্প ও ড্রেজার বা অন্য কোনো মাধ্যমে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। একইসঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি জমির উপরি-ভাগের উর্বর মাটি বা টপসয়েল কাটাকাটি এবং পার্শ্ববর্তী জমির ক্ষতি হয় এমন কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু এর পরেও বন্ধ হয়নি নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন।

রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, যমুনেশ্বরীতে অনুমোদিত কোন বালুমহাল নেই। যত জায়গায় বালু উত্তোলন করা হয় এসবের সাথে হয় প্রভাবশালী তা নাহলে প্রশাসনের লোকজন জড়িত থাকে। সরকারি লোকজন যদি মনে করে বালু উত্তোলন বন্ধ হবে তাহলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হতো। এজন্য সরকারি লোকজনদের জবাবদিহিতা থাকা দরকার একই সাথে বালুখেকোদের শাস্তি নিশ্চিত করা হলে বালু উত্তোলন বন্ধ হবে।

রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে ২০ লাখ টাকা জরিমানা ও চারজনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত