নওগাঁর মহাদেবপুরে কেঁচো সার উৎপাদন করে সফল হয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা অনুজ কুমার মন্ডল। তার উৎপাদিত সার স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। দামে কম ও নিরাপদ হওয়ায় কেঁচো সার ব্যবহারে ঝুঁকছেন চাষিরা। জমির উর্বরতা বাড়াতে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের। ধান, পাট ও শাক-সবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের ফল ও ফসলে কেঁচো সার ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে একদিকে মাটির গুণগতমান ভালো থাকছে। অপরদিকে উৎপাদন বেশি হওয়ায় লাভবান হচ্ছে কৃষক। তবে কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা বাড়ানোসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে বাড়বে উৎপাদন। এতে মাটির উর্বরতা থাকবে অটুট, বাড়বে নিরাপদ কৃষি উৎপাদন এমনটা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ৯৬ জন উদ্যোক্তা ৯০টি খামারে প্রায় ১৫০০ টন কেঁচো সার উৎপাদন করছে। যার বাজার মূল্য অন্তত ২ কোটি টাকা। তবে প্রশিক্ষণসহ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হলে কেঁচো সার উৎপাদনের পাশাপাশি মাটির উর্বরতা বাড়বে এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমবে।
জেলার মহাদেবপুর উপজেলার জোতহরী গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা অনুজ কুমার মন্ডল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিষয়ে পড়াশোনা শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন। চাকরির সুবাদে কেঁচোসার সম্পর্কে ধারণা পেয়ে ২০২৩ সালে শুরু করেন কেঁচো সার তৈরির কাজ। প্রথমে নিজের চাহিদা পূরণে শুরুতে ৫টি রিং ও উন্নত জাতের কেঁচো এবং গোবর দিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। যেখানে খরচ পড়ে প্রায় ৩ হাজার টাকা। খরচ বাদে ১ মাসে লাভ থাকে অন্তত ২ হাজার টাকা। পরবর্তীতে চাহিদা ভালো থাকায় ২০২৪ সালে উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন। উদ্যোক্তা অনুজ কুমার মন্ডল বলেন, এলাকার বিভিন্ন কৃষকের কাছ থেকে ৫০ টাকা মণ হিসেবে গোবর সংগ্রহ করা হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা দিয়ে ভরানো হয় ক্যারেট, রিং ও চৌবাচ্চা। তারপর সেখানে দেওয়া হয় কেঁচো। এভাবে গোবর ও কেঁচোর মিশ্রণে ২২-২৫ দিন পর তৈরি হয় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। সেই সার থেকে চালনির সাহায্যে কেঁচো আলাদা করে ভালোভাবে ছেঁকে নেওয়া হয় সার। এভাবে প্রস্তুত হয় ফসলে ব্যবহার উপযোগী কেঁচো সার। বর্তমানে ৬৬০ ক্যারেট ও ১৫টি রিং ও চৌবাচ্চা দিয়ে মাসে অন্তত ৫টন কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। পাইকারিতে ১২ টাকা কেজি এবং খুচরা পর্যায়ে ১৫ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শুরুতে কৃষকদের কেঁচো সার সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তাদের বিভিন্নভাবে উদ্ধৃদ্ধ করতে হয়েছিল। বর্তমানে কৃষকরা নিজ থেকেই ব্যবহার করছে। আশপাশের এলাকায় কৃষিতে বিপ্লব ঘটানে ইচ্ছে আছে। যেখানে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে অর্গানিক ব্যবহার করা যায়। এ লক্ষ্যে আরও বড় পরিসরে খামার করার পরিকল্পনা আছে। আমার খামারে ৪ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। যারা দিনে ২০০-৪০০ টাকা মজুরিতে কাজ করছে। খরচ বাদে মাসে লাভ থাকছে অন্তত ৪০-৫০ হাজার টাকা।
জোতহরী গ্রামের কৃষক মুকুল বলেন, ধানের জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করায় বিঘাপ্রতি প্রায় ৪-৫ হাজার টাকা খরচ হতো। তবে দুই বছর থেকে কেঁচো সার ব্যবহারের পর খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে। মাটিও ভালো থাকছে আবার ফসলও ভালো হচ্ছে।
আরেক কৃষক অজিত কুমার বলেন, ৫ কাঠা জমিতে মরিচের আবাদ করেছি। কেঁচো সার ব্যবহারের পর গাছগুলো সতেজ থাকে এবং আবাদের পরিমাণও বাড়ছে। বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি ও ফসলে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভালো ফলন পেয়ে লাভবান হওয়া যাচ্ছে। বলা যায় হাতের কাছে প্রতিকেজি ১২-১৫ টাকা হিসেবে কেঁচো সার পাওয়ায় সুবিধা হচ্ছে।
মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, কৃষক না বুঝে জমিতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে। এতে জমির উর্বরতা কমে আসায় ফসলও কমছে। তবে বর্তমানে অনেক কৃষক কেঁচো সার ব্যবহারে উদ্বৃদ্ধ হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তরুণ উদ্যোক্তা অনুজ কুমার মন্ডলকে প্রণোদনা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। তার খামারে প্রতিমাসে ৫ হাজার টন কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া এ খামার থেকে প্রতিমাসে ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা কেঁচো সার বিক্রি হচ্ছে। এ প্রকল্পের উদ্যেশ হচ্ছে, রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারে উদ্বৃদ্ধকরণ।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও গুণগতমান ঠিক রাখতে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। এরইমধ্যে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোষ্ট) ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এলক্ষ্যে জৈব সার ও কেঁচো সার উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। কেঁচো সার ব্যবহারে কৃষকদের মাঝে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৃষক নিজেই এখন কেঁচো সার উৎপাদন করে নিজের চাহিদা পূরণ করছে।
আবার অনেকে খামার থেকে কিনে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রণোদনা দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে জমি ও ফসলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে আসছে এবং কৃষকরাও উপকৃত হচ্ছে।