
রোমে পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে ও পরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও সাক্ষাৎ করেছেন। এতে বিশ্ব নেতাদের বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। বিশেষকরে ঢাকা ও মার্কোসার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেন, যাতে উভয় অঞ্চলের টেকসই সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়। গত শনিবার পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। রোমের ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসও পোপের শেষকৃত্যে যোগ দেন। পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে গতকাল বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে ইতালির রোম ত্যাগ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন ক্যাথলিক চার্চের জ্যেষ্ঠ নেতা কার্ডিনাল সিলভানো মারিয়া তোমাসি ও কার্ডিনাল জ্যাকব কুভাকাদ। দুই কার্ডিনালই দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে পোপ ফ্রান্সিসের আজীবন লক্ষ্য, দারিদ্র্য দূরীকরণে তার প্রচেষ্টা এবং যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা স্মরণ করেন। তারা ইউনূসের কাজের গভীর প্রশংসা করেন। তাকে প্রয়াত পোপের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেন। ড. ইউনূস পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে তার দীর্ঘ সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে সবাইকে আলিঙ্গন করার ক্ষমতা পোপের রয়েছে।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন।’ তিনি পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে বহুবার সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেন এবং ভ্যাটিকান ব্যাংকের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে লেখা তার একটি সমালোচনামূলক চিঠি ভ্যাটিকানের অফিসিয়াল সংবাদপত্র ল’ ওসেরভেটোর রোমানোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল তা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি লিখেছিলাম, দরিদ্রদের প্রতি আরও বন্ধুত্বপূর্ণ করার জন্য কীভাবে ভ্যাটিকানের ব্যাংকটিকে সংস্কার করা উচিত। আমি পোপের পারফরম্যান্স এবং বিতর্কের সমালোচনা করেছিলাম। তারপরও তিনি পুরো চিঠিটি প্রকাশ করেছেন। ড. ইউনূস জানান, পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানের ব্যাংকিং পদ্ধতির সংস্কার এবং চার্চের দরিদ্রবান্ধব উদ্যোগ সম্প্রসারণে মনোনিবেশ করে বেশ কয়েকটি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। শূন্য বেকারত্ব, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য নীট কার্বন নিঃসরণের বিশ্ব গড়ে তোলার বিষয়ে ড. ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে গত নভেম্বরে ভ্যাটিকান রোমে পোপ ফ্রান্সিস-ইউনূস থ্রি জিরো ক্লাব চালু করে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি একজন মুসলিম। তবুও পোপ ফ্রান্সিস কখনওই ভিন্ন ধর্মের ব্যক্তির পাশে তার নাম ব্যবহার করতে আপত্তি করেননি।’ প্রয়াত পোপের সঙ্গে সমৃদ্ধ স্মৃতির কথা তুলে ধরে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘তিনি কখনওই আমাকে বহিরাগত মনে করেননি।’ কার্ডিনাল তোমাসির সঙ্গে সাক্ষাৎ: সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর করা কার্ডিনাল তোমাসি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ইউক্রেন ও গাজায় সংঘাত অবসানের আহ্বানে পোপ ফ্রান্সিসের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন উভয় নেতা। তোমাসি তার ভিয়েতনাম সফরের প্রতিফলন করে বলেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি দেখছে।’ তিনি ওই অঞ্চলে আরও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার ওপর জোর দেন। ড. ইউনূস ভিয়েতনামের চমকপ্রদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে বলেন, ‘তার সরকার আরও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করার প্রচেষ্টায় দক্ষিণ এশীয় এই দেশটিকে অনুকরণের চেষ্টা করছে।’ কার্ডিনাল তোমাসি জানান, তিনি আশা করেন, পরবর্তী পোপ ফ্রান্সিসের অনানুষ্ঠানিকতা বজায় রাখবেন এবং দেশগুলোর মধ্যে শান্তির সংলাপকে উৎসাহিত করবেন।
কার্ডিনাল জ্যাকব কুভাকাডের সঙ্গে বৈঠক: ভারতের কেরালা রাজ্য থেকে আসা কার্ডিনাল কুভাকাড ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের ক্যাথলিক চার্চ এ বছরের সেপ্টেম্বরে একটি আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করবে, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের নেতারা একত্রিত হবেন। ড. ইউনূস বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে অব্যাহত সংলাপের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতি দেশটির প্রতিশ্রুতি এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টা তুলে ধরেন। বৈঠকগুলোতে আরও উপস্থিত ছিলেন এসডিজি সমন্বয়কারী লামিয়া মোরশেদ, ভ্যাটিকানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক আরিফুল ইসলাম এবং ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রকিবুল হক।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ: উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিও লুবেটকিন গত শনিবার ইতালির রোমে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে তারা পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সাক্ষাতে উভয় নেতা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। তারা বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি এবং লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যে সহযোগিতার সেতুবন্ধন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুবেটকিন উরুগুয়ে ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের আহ্বান জানান। তিনি বিশেষভাবে ঢাকা ও মার্কোসার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেন, যাতে উভয় অঞ্চলের টেকসই সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়। অধ্যাপক ইউনূস ও মন্ত্রী লুবেটকিন যুবসমাজে বিনিয়োগ এবং সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ বিস্তারের কৌশল নিয়েও আলোচনা করেন। তারা ‘তিন শূন্য’ (থ্রি জিরো) বিশ্বের অভিন্ন স্বপ্ন পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস নিয়মিত উচ্চপর্যায়ের সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুবেটকিনকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে এবং পরে প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। যাদের মধ্যে ছিলেন- জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লায়েন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট মন্টেনেগ্রো, লুক্সেমবার্গের গ্র্যান্ড ডিউক ও গ্র্যান্ড ডাচেস, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট, হন্ডুরাসের প্রধানমন্ত্রী, আইসল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট, পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট, বেলজিয়ামের রাজা ও রানি, বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী, মোনাকোর প্রিন্স দ্বিতীয় অ্যালবার্ট, নরওয়ের প্রিন্স ও প্রিন্সেস, তিউনিসিয়ার প্রধানমন্ত্রী, লিচেনস্টাইনের প্রিন্স ও প্রিন্সেস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি টমাস বাখ, শ্রীলঙ্কা, বাহরাইন ও সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।