ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

এখনও ছয় সন্তানের অপেক্ষায় দুই বোন

এখনও ছয় সন্তানের অপেক্ষায় দুই বোন

গত রোববার, ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টা। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার তাবালেরচর। বেড়িবাঁধের কিনারায় দেখা হয় আয়েশা বেগম ও পুতিলা বেগমের সঙ্গে। তারা দু’জনই আপন বোন। ভয়াল ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে দুই বোন হারিয়েছে ৬ ছেলে-মেয়েকে। ছেলে-মেয়ে হারানোর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। দীর্ঘ ৩৪ বছরেও ভুলতে পারছে না সন্তান হারানো বেদনা। প্রায় সময় বেড়িবাঁধের কিনারায় বসে ৬ সন্তান ফেরার প্রহর গুনেন। ঘূর্ণিঝড়ে তাদের ঘরটি বিলীন হওয়ার পর বেড়িবাঁধের পাশে নতুন ঘর তৈরি করেন। পুতিলা বেগম ঘূর্ণিঝড়ের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা ‘কবরের পাড়ে গেলেও ভুলতে পারব না’। ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে দু’চোখের পানি ছেড়ে দেন দুই বোন। আয়েশা বেগম ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ বলেন, ‘মা-বাবাকে হারিয়েছি। একসঙ্গে হারিয়ে যাওয়া দুই সন্তানের নিথর দেহের খোঁজ পায়নি। এখনও ৯১ ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে পড়লে আতঙ্কে ঘুম হয় না।’ একই এলাকায় দেখা হয় বৃদ্ধ হাজী আবুল কালাম মিয়াজি ও ছৈয়দ আলমের সঙ্গে। তারাও বর্ণনা দেন প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের। তারা ওই দিনে স্বজন হারানো বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ছৈয়দ আলম বলেন, ‘স্বজন হারিয়েও রক্ষা পাচ্ছি না। বছরজুড়েই আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হয়। টেকসই বেড়িবাঁধের আশায় ৩৪ বছর অপেক্ষা করেছি। সরকার আসে যায়। শুধুই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের গল্প শুনি।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘বেড়িবাঁধ নির্মাণ হবে সেই আশা ছেড়ে দিয়েছি। আলাপের ফাঁকে, তার কয়েকজন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।’ ’৭১ এ ঘূর্ণিঝড় দেখা হাজী আবুল কালাম মিয়াজি বলেন, ‘আমি ’৭১ এ ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। তবে ’৯১-এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা দেখেনি। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে পড়লে এখনও চমকে উঠি। বেড়িবাঁধে ঘুরতে ঘুরতে ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের নানা স্মৃতি, অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন মিয়াজি। তিনিও বরাবরের মতোই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি তুলে বলেন, ‘গেল সরকারের ১৭ বছর ধরে শুনে আসছি। টেকসই বেড়িবাঁধ হচ্ছে। আমরা এই গল্প আর শুনতে চায় না। ইউনূস সরকার আমাদের টেকসই বেড়িবাঁধ করে দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।’

উত্তর ধুরুং এলাকায় সাংবাদিক যাওয়ার খবরে ছুটে আসেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম। তিনি বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের চারটি পয়েন্টে ভাঙন শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি। দ্রুত জিওব্যাগ না দিলে ঘরবাড়ি রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। সম্প্রতি স্থাপন করা জিওব্যাগগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম হওয়ার কথা তুলে ধরেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এক সময়ে ৫৮ বর্গমাইল ছিল কুতুবদিয়ার আয়তন। এখন এর আয়তন মাত্র ২০ বর্গমাইল। সূত্র মতে, ১৮৮০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত কুতুবদিয়া দ্বীপের আয়তন ছিল ৫৭-৫৮ বর্গমাইল, ১৯০১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আয়তন ছিল ৩৪-৩৫ বর্গমাইল, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত আয়তন ছিল ২৬-২৭ বর্গমাইল, ১৯৬০ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আয়তন ছিল ২২-২৩ বর্গমাইল, ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আয়তন ছিল ২০ বর্গমাইল এবং ১৯০৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ দ্বীপের আয়তন ২০ বর্গমাইলের চেয়েও কম ছিল। সংকোচনের এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দ্বীপের অবস্থা কী হবে তা নিয়ে দ্বীপবাসী শংকিত।

বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৭৯৭ থেকে ১৯৯৭১ সাল পর্যন্ত ২০০ বছরে অন্তত: ৬৩ বার মনে রাখার মতো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। অন্য এক হিসেবে দেখা গেছে, গত ৩৭ বছরে ৩৪টি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সাড়ে ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। তবে সবচেয়ে ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছিল উপকূলীয় ভূখণ্ডে। কুতুবদিয়া ছাড়ারও তখন কক্সবাজার, মহেশখালী, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চকরিয়া, সন্দীপ ও সিতাকুণ্ডের বিস্তীর্ণ জনপদে গড়ে ৮-১০ মিটার উঁচু ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস লন্ডভন্ড করে দেয়। যে স্মৃতি উপকূলের মানুষ ভুলতে পারেনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত