কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া এলাকার কৃষক হাফিজুল ইসলাম। ৯ম শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়ে ইতি হয় লেখাপড়ার। তারপর থেকে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কৃষি অফিসের পরামর্শে এ বছর শাহি জাতের পেঁপে চাষ করে বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি। মাত্র ১ বিঘা জমিতে ১ লাখ টাকার পেঁপে বিক্রয় করে এলাকার কৃষকদের মাঝে সাড়া ফেলেছেন তিনি। হাফিজুল এখন এলাকার অন্য চাষিদের কাছে মডেল। তার পুরো বাগানটি যেন চোখ জোড়ানো এক খেত। গাছের মাঝ থেকে ডগা পর্যন্ত ছোট, মাঝারি, বড় আকারের পেঁপে ধরে রয়েছে। হাফিজুলের সাফল্য দেখে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন এই পেঁপেচাষে। গতকাল সোমবার সকালে হাফিজুলকে দেখা যায় তার পেঁপের বাগানে কাজ করতে। পুরো বাগানঘুরে দেখা যায়, এ যেন গাছে টাকা ধরে রয়েছে। এক একটি গাছে প্রচুর পরিমাণে পেঁপে। ৪ দিন আগেও তিনি ৬০ মণ পেঁপে বিক্রি করেছেন তার ২২ কাঠা জমির পেঁপে বাগান থেকে। কথা হয় হাফিজুলের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘৫ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলাম আমি। পরিবারের টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারিনি। মাঠের চাষাবাদ শুরু করি। তার পরে এলাকার অন্য চাষিদের মতো তামাকের চাষ শুরু করি। এক সময় দেখি, তামাকে একসঙ্গে টাকা পাওয়া যায় ঠিকই; কিন্তু প্রচুর কাজ করতে হয়। আর বাড়ির সকলে মিলে এত কাজের পরেও বিক্রি করলে খুব একটা লাভ হয় না।‘
তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের মে মাসে আমাদের চিথলিয়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার সুকেশ রঞ্জন পাল আমাকে পেঁপে চাষ সম্পর্কে পরামর্শ দেন। কীভাবে বাণিজ্যিকভাবে এ পেঁপের চাষ করা যায় সেটা সম্পর্কে জানি। পরে কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করি পেঁপে চাষ। সে সময় এই পেঁপে চাষ সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলত।’ তিনি বলেন, ‘মাত্র ১ বিঘা জমিতে পেঁপের চাষ শুরু করি। গাছ লাগানোর পরে ৩-৪ মাসে গাছে পেঁপে ধরলো এবং ৫ মাস পরেই সেটা বাজারে বিক্রির উপযোগী হলো। পেঁপে চাষ খরচ ও খাটুনি কম। আর ভালো দাম পেলে খুবই লাভ হয়। তাই আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর ২ বিঘা জমিতে পেঁপের চাষ করি। বিঘা প্রতি আমার ২০ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছিল। আর প্রায় ৯০ হাজার টাকার বেশি করে বিঘা প্রতি পেঁপে বিক্রি করেছিল।’ তিনি বলেন, ‘এ বছর আমি ৮ বিঘা জমিতে হাইব্রিড শাহি জাতের পেঁপের চাষ করেছিলাম। অতিরিক্ত বৃষ্টি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমার ৭ বিঘা জমির পেঁপে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। সবেমাত্র এক একগাছে ৬-৭ কেজি করে পেঁপে হয়েছিল। বৃষ্টির কারণে গাছগুলো মরে গেল। তবে সে ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে আমার এই ২২ কাঠা জমির পেঁপেতেই।’ তিনি বলেন, ‘বাজারে পেঁপের যে দাম তাতে খুবই লাভ। আগে ৩-৪ টাকা কেজি পেঁপে বিক্রি করেছি। তার পরেও লাভ হয়েছে। এখন তো মাঠ থেকেই পাইকারি বিক্রি করছি ২০ টাকা কেজি দরে। বর্তমানে আমার ২২ কাঠা জমিতে ৪৩০-৪৪০টি পেঁপে গাছ আছে। এরমধ্যেই ৪০ রয়েছে পুরুষ গাছ। বাকি সব গাছগুলোতে বেশ ভালো পেঁপে ধরেছে। খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকার মতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি গাছে ২০ কেজি করে পেঁপে পাব বলে আশা করি। আর এবার পেঁপের সাইজ খুবই ভালো। আর খেতেও খুব সুস্বাদু। ৪ দিন আগেও এই জমি থেকে ৬০ মণ পেঁপে বিক্রি করেছি। এর আগেও ৩ বার পেঁপে বিক্রি করেছি।
এক মাস পর পর এ জমি থেকে পেঁপে বিক্রি করি। এরইমধ্যে আমি এক লাখ টাকার উপরে পেঁপে বিক্রি করেছি এবং আরও ৫০ হাজার টাকার পেঁপে বিক্রি করব এই জমি থেকেই। অন্য বছর ৪ বিঘায় যে লাভ হয় না, এ বছর বাজারে দাম ভালো হওয়ায় এক বিঘাতেই তার বেশি লাভ হচ্ছে।‘ তিনি বলেন, ‘পেঁপে চাষের ক্ষেত্রে খুব একটা খরচ নেই। আর পরিশ্রমও কম। আমার কাছ থেকে অনেকেই এই পেঁপে চাষ সম্পর্কে জেনেছে। এছাড়া উপজেলা কৃষি অফিসের লোকজন নিয়মিত আমার খেত পরিদর্শন করে আমাকে পরামর্শ দেন। যার কারণে কখন কি করতে হবে তা সঠিক নিয়মে করতে পারি।’ অন্যান্য চাষের চেয়ে পেঁপে চাষ লাভজনক হওয়ায় হাফিজুল ইসলামের মতো এলাকার অন্য কৃষকরাও আগ্রহ দেখাচ্ছেন এই পেঁপে চাষে।
একই এলাকার কৃষক মিনহাজ আলী বলেন, ‘যে পরিমাণ পেঁপে ধরছে তাতে তো দেখছি, এই পেঁপে চাষ লাভজনক ফসল। হাফিজুলের দেখা দেখি তার পাশের জমিতে করবে এই পেঁপে চাষ, এমন করে এই পুরো মাঠই তামাকের পরিবর্তে পেঁপে চাষে ঝুঁকবে কৃষকরা। তামাকের মতো তো এত খাটনির কাজ না, ঘুম কামাই করা লাগে না, মাঠ থেকেই বিক্রি করা যায়। সামনে বছর আমি নিজেও ১০ কাঠা জমিতে পেঁপে চাষ করব বলে মনে করছি।‘ কৃষক আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘সবজি হিসাবে পেঁপে খেতে খুবই ভালো লাগে। আর চাষ করতে খরচ কম।
এটা চাষ করাও সহজ। আমি ভাবছি ১ বিঘা জমিতে এ শাহি জাতের পেঁপের বাগান করব।’ খুবই কম সময়ে এ পেঁপে চাষ করে কৃষকরা বেশ ভালো লাভবান হতে পারবেন বলে জানান মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। তিনি জানান, ‘পুষ্টি মানের দিক থেকে পেঁপে খুবই স্বাস্থ্যকর একটি খাদ্য। আর পেঁপের চাষাবাদও খুব সহজ। আর ফলনও খুবই ভালো। বাজারে দামও বেশ ভালো। আমরা কৃষকদের এ পেঁপেসহ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, এমন ফসল চাষাবাদের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি।’
‘কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সূফি রফিকুজ্জামান বলেন, আমরা কৃষকদের বিনামূল্যে প্রণোদনায় সার, বীজ প্রদান করি। এছাড়া কারিগরি সহযোগিতা এবং পেঁপেসহ বিভিন্ন ফসল চাষের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করি। চিথলিয়া এলাকার হাফিজুল ইসলাম শাহি জাতের পেঁপে চাষ করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ প্রদান করা হয়। এবছর তিনি বেশ ভালো দাম পেয়েছেন। তার এই সফল্য দেখে অনেক শিক্ষিত বেকার এখন পেঁপে চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।