বিশাল পাহাড় ও উঁচু-নিচু টিলায় বিভিন্ন মৌসুমি ফসলে পরিপূর্ণ প্রকৃতির রূপসীকন্যা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। এখানে চায়ের পাশাপাশি কাঁঠাল, আনারস ও লেবুর সুখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। দেশের চাহিদা পূরণে সবচেয়ে বেশি আনারস আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল উৎপন্ন হয় শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি ভূমিতে। এই উপজেলার আনারস সারাদেশ সুপ্রসিদ্ধ এবং স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। এ মধুমাসে বাজারজুড়ে অন্য ফলের সঙ্গে শ্রীমঙ্গলের আনারস জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। শ্রীমঙ্গলের চাষিরা জানান, এখানকার পাহাড়ি উঁচু-নিচু টিলায় ষাটের দশক থেকে আনারস চাষ শুরু হয়েছিল। এখানকার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু আনারস চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এখানে বারো মাস আনারসের চাষ করা হয়। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে সারা বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয় শ্রীমঙ্গলের আনারস। আনারস সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। তার সঙ্গে এটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল।
সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক আনারস চাষ হয়। তবে শ্রীমঙ্গলের আনারসের খ্যাতি সারা দেশে। এখানে চা বাগান আর পাহাড়ে রয়েছে আনারস বাগান। চায়ের রাজধানীতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে আনারসের সারি সারি বাগান। এই আনারসের গাছগুলো নিচ থেকে টিলার উপরে এমনভাবে উঠেছে দূর থেকে মনে হবে যেন একদল পিপিলিকা ডানা মেলে সারি বেঁধে উপরে উঠছে। জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, মে থেকে জুন পর্যন্ত আনারসের ভরা মৌসুম। এ বছর মৌলভীবাজার জেলার প্রায় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এই অঞ্চলে হানিকুইন ও জাইনকিউ নামের আনারসের উৎপাদন হয়ে আসছে। সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই শত শত ঠেলাগাড়ি, জিপ ও পিকআপে করে চাষিরা আনারস নিয়ে আসে স্থানীয় আড়ৎগুলোতে। উপজেলার নন্দরানী, বালিশিরা, নূরজাহান, ডলুছড়া, বিষামণি, মাইজদিহি, হোসেনাবাদ, এমআর খান, সাতগাঁও, মোহাজেরাবাদসহ এলাকা থেকে প্রচুর আনারস আসে বাজারে। বাজারে আসা ঠেলাগাড়িগুলোর সামনের দিক মাটিতে মুখ দিয়ে ওপরের দিকে রাখা আনারসকে ডিসপ্লের মতো সাজিয়ে রাখা হয়। যেন দূর-দূরান্ত থেকে ছোট-বড় আড়তদার ও পাইকারি-খুচরা ক্রেতারা এগুলো দেখে আকৃষ্ট হন। আর এখান থেকেই আনারস যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। একেকটা ঠেলাগাড়িতে ১৫০ থেকে ৫০০ পিস আনারস সুন্দর করে ডিসপ্লে করে রাখা হয়। আর সেগুলো সাইজ অনুযায়ী বিক্রি হয়ে থাকে।
পার্শ্ববর্তী উপজেলা কমলগঞ্জ, চুনারুঘাট ও বাহুবল থেকেও আনারস আসে শ্রীমঙ্গলের বাজারে। বাগান মালিক ও আড়তদারদের তথ্য মতে বাজারের ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন আড়তদার রয়েছেন। যাদের কাছে বাগান মালিকরা আনারস বিক্রি করেন।
মেসার্স মনজুর আলী আড়তদার অভিযোগ করে মছর উদ্দিন বলেন, আনারসের ফলন ভালো হয়েছে; কিন্তু আনারস সংরক্ষণের অভাবে পচে যাচ্ছে। পরিপক্ব আনারস বেশি দিন বাগানে রাখা যায় না, বৃষ্টি হলে সেই আনারস বাগানেই পচে যায়। সে জন্য আনারস সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
আশিক বাণিজ্যালয়ের আড়তদার আশিকুর রহমান বলেন, অন্য বছরের চেয়ে এবার আনারসের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। আমরা ৬ মাস ধরে মৌসুমি এই সিজনের আনারস বিক্রি করছি, এবারের আনারসের স্বাদণ্ডগন্ধ অনেক ভালো, তাই ক্রেতাদের চাহিদা অনেক, দামও ভালো পাচ্ছি।
আনারস কিনতে আসা সোহেল, রিয়াদ, জাহেদ, লিয়াকত ও রাজন জানান, শ্রীমঙ্গলের আনারসের স্বাদই আলাদা। তাই কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ থেকে কিনতে এসেছেন। এখানে প্রতি হালি (৪ পিচ) আনারস ৫০-১২০ টাকা করে কিনে নিয়েছেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো: আলাউদ্দিন বলেন, এবছর শ্রীমঙ্গল ৪২০ হেক্টর আনারস লেবু চাষ হয়েছে ১২৫০ হেক্টর চাষ হয়েছে। আমরা কৃষি অফিস থেকে ২০ জন কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে ২ হাজার ২৫০টি আনারসের চারা দিয়েছি। সকল চাষিকে কৃষি অফিস সবসময় ভালো পরামর্শ দিয়ে আসছে। আনারসের পাশাপাশি লেবু ও নাগামরিচ ও বিভিন্ন ফলের চাষ হয় এ অঞ্চলে। মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) নিলুফার ইয়াসমিন মোনালিসা সুইটি জানান, বর্তমানে জেলায় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হচ্ছে। এবছর আমাদের এলাকায় প্রচণ্ড খরা দিয়েছে, যার কারণে হানিকুইন জাতের আনারসগুলো একবারে ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু বিক্রি করার জন্য পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা জুলডুগি আনারস বলে বিক্রি করছে। আমাদের এলাকায় এই আনারস চাষ হয় না। কিন্ত বিক্রেতারা এ নামে বিক্রি করছেন। আনারস ও লেবু সংরক্ষণাগার ও প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।