এনবিআর বিলুপ্ত করে প্রণীত রাজস্ব অধ্যাদেশ বাতিল এবং টেকসই রাজস্ব সংস্কারের দাবিতে দেশের কাস্টমস, ভ্যাট ও ট্যাক্স বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়ে আজ রোববারও কলম বিরতি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকাল ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তৃতীয় দিনের মতো কলম বিরতি কর্মসূচি শেষে এমন ঘোষণা দিয়েছে সংস্কার ঐক্য পরিষদ। আজ রোববার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা কলম বিরতি চলবে। পূর্বের মতোই আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, রপ্তানি কার্যক্রম এবং জাতীয় বাজেট প্রণয়ন কার্যক্রম এই কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।
আজকের পাঁচ ঘণ্টার কলম বিরতি কর্মসূচিতে সব প্রতিষ্ঠানের সব স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেন। ঐক্য পরিষদের দাবি, এনবিআর বিলুপ্ত করে যে রাজস্ব অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে, তা বাস্তবভিত্তিক নয় এবং এতে হাজারো কর্মকর্তা-কর্মচারীর মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। এমনকি সংস্কার কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশগুলো এখনও গোপন রাখা হয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য এবং এতে রাজস্ব ব্যবস্থায় সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আজকের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি যৌক্তিক দাবির বিষয়ে গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সমর্থনের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানানো হয়। তবে এ কর্মসূচির কারণে করদাতা ও সেবাপ্রার্থীদের যে সাময়িক ভোগান্তি হয়েছে, সেজন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছে পরিষদ। তারা জানিয়েছে, আন্দোলন সফল হলে কর্মীরা অতিরিক্ত সময় দিয়ে অনিষ্পন্ন কাজ দ্রুত সম্পন্ন করবেন।
এনবিআরসহ দেশের বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুসারে জানা যায়, সকাল ১০টা থেকেই অফিস যথারীতি শুরু হলেও সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস উপস্থিত ছিলেন। সব ধরনের কাজ বন্ধ ছিল। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, রপ্তানি কার্যক্রম এবং এনবিআরের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন কার্যক্রম এই কর্মসূচির আওতা বহির্ভূত ছিল।
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, গত শুক্রবার কতিপয় বহিরাগত অনুপ্রবেশ করানোর মাধ্যমে আমাদের আন্দোলনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টাকে আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। সাধারণ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে বিসিএস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশনের অনির্বাচিত নির্বাহী কমিটিকে অবৈধ ও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে, বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির প্রায় সব সদস্য পদত্যাগ করায় এটিও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সুতরাং এই দুই অ্যাসোসিয়েশন এখন আর এই দুই ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। এমতাবস্থায়, বিলুপ্ত ও অকার্যকর এই দুই কমিটির নামে যে কোনো বক্তৃতা, বিবৃতি ব্যক্তিগত বলে গণ্য হবে।
তারা আরও বলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এই অচলাবস্থার নিরসন চাই। আশা করছি প্রধান উপদেষ্টার সানুগ্রহ নির্দেশনায় সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য বসবেন। আলোচনার দরজা আমাদের পক্ষ থেকে সবসময়ই খোলা ছিল, আছে এবং থাকবে।
এর আগে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার কলম বিরতি পালন করে এনবিআরের আওতাধীন সব অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
গত ১২ মে রাতে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছে। খসড়া অধ্যাদেশ জারির পর থেকেই আন্দোলন শুরু করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু সরকার তাদের মতামত উপেক্ষা করেই প্রায় অপরিবর্তিত খসড়ার ভিত্তিতে চূড়ান্ত অধ্যাদেশ জারি করেছে। নতুন অধ্যাদেশ জারির ফলে দীর্ঘদিনের রাজস্ব সংস্থা এনবিআর কার্যত বিলুপ্ত হলো। এখন থেকে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’- এই দুই ভাগে পরিচালিত হবে।
এদিকে বিদ্যমান কাঠামো পুনর্গঠন করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য জারি করা অধ্যাদেশটির বৈধতা নিয়ে রিট করেছেন এক আইনজীবী। গতকাল শনিবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জুয়েল আজাদ হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন। তিনি বলেন, ‘বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে চলতি সপ্তাহে রিটের ওপর শুনানি হতে পারে। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ শিরোনামের ওই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
রিটের প্রার্থনায় দেখা যায়, সংবিধানের ২৬, ৩১ ও ২৯(১) অনুচ্ছেদের আলোকে ওই অধ্যাদেশটি কেন সাংঘর্ষিক এবং আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে। রুল হলে তা বিচারাধীন অবস্থায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সংস্কার বিষয়ে অংশীজনদের (দলগত) প্রস্তাব প্রকাশ করতে বিবাদীদের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া রুল বিচারাধীন অবস্থায় ওই অধ্যাদেশের কার্যক্রমও স্থগিত চাওয়া হয়েছে রিটে। আইনসচিব ও অর্থসচিবকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল, ৩১ অনুচ্ছেদে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং ২৯(১) অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
রিটের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আইনজীবী জুয়েল আজাদ বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা না করেই তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গঠনসংক্রান্ত ১৯৭২ সালের আদেশ (রাষ্ট্রপতির) বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটা বাতিল করতে হলে যথাযথ ন্যায্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। রাজস্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত অংশীজনদের মতামত নেয়া প্রয়োজন ছিল।
জুয়েল আজাদ আরও বলেন, অংশীজনরা এ বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে। তবে প্রস্তাবগুলো কী ছিল, তা প্রকাশ না করেই অধ্যাদেশ জারি করা সমীচীন হয়নি। বিগত বছরগুলো এনবিআর যথাযথভাবেই তাদের কাজ করেছে। তাই এটি বিলুপ্ত না করে সংস্কার করা যেত।
একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি বিলুপ্ত করতে যাওয়া সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ ‘সমর্থন করে না’ উল্লেখ করে আইনজীবী জুয়েল আজাদ বলেন, এখন দুটি বিভাগের শীর্ষ পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার থেকে পূরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের কর্মকর্তারা বঞ্চিত হবেন, যা সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদ সমর্থন করে না। মূলত এসব যুক্তিতে রিটটি করা হয়েছে।
এনবিআর বিলুপ্তি নিয়ে উদ্বেগ জানালো টিআইবি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ক দুটি আলাদা বিভাগ তৈরি করতে তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশ জারি এবং এর ফলে রাজস্ব ব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের করায়ত্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করে টিআইবি।
সংস্থাটি জানায়, নীতির স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানো ও রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণের যে যৌক্তিক ভিত্তির ওপর ভর করে এ পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে, তার স্থলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্বাহী বিভাগ থেকে যে ন্যূনতম স্বাধীনতা ভোগ করার কথা তার সুযোগ থাকলো না। এতে বলা হয়, এনবিআর সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশসমূহ পাশ কাটিয়ে তড়িঘড়ি অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলে মনে করে টিআইবি। রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রাখতে অবিলম্বে অধ্যাদেশটি যথোপযুক্ত সংশোধনের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশসমূহকে পাশ কাটিয়ে অধ্যাদেশ জারির উদ্দেশ্য কী? কার স্বার্থে অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ সুপারিশসমূহ উপেক্ষা করা হলো? রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার নামে যে বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে প্রক্রিয়াটিই স্বচ্ছ কি না, এমন প্রশ্ন ওঠাও অমূলক নয়। তাছাড়া, এই তুঘলকি পরিবর্তনের ফলে এর মূল উদ্দেশ্য রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, এ বিষয়ে নির্মোহ সংশ্লিষ্ট জ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ কতটুকু করা হয়েছে? ড. জামান বলেন, অধ্যাদেশে রাজস্ব বোর্ডের বিকেন্দ্রীকরণের নামে সরকারের, বিশেষত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নত চর্চা অনুযায়ী, একটি দেশের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতপূর্বক স্বতন্ত্র সংস্থা, বোর্ড বা এজেন্সি করা প্রয়োজন, যাতে তা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের আওতামুক্ত থাকে। অথচ পরামর্শক কমিটির মূল সুপারিশকে উপেক্ষা করে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে নির্বাহী বিভাগের অধীন দুটি বিভাগে পরিণত করা হয়েছে। ফলে করনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বার্থের সংঘাতসহ বিভিন্ন অনিয়মের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। এ সুযোগ আরও বাড়তে পারে, এমন সম্ভাবনাও অমূলক নয়। প্রত্যাশিত রাজস্ব অর্জন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নবগঠিত বিভাগ দুটিকে আইনি সুরক্ষার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের এই সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে চলমান আন্তঃক্যাডার টেনশনে নতুন ইন্ধন জুগিয়েছে। তাও অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই, যোগ করেন তিনি।