ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাজায় ভয়াবহ পরিস্থিতি

গাজায় ভয়াবহ পরিস্থিতি

গাজায় ভয়াবহ সময় পার করছে শিশুরা। সেখানে এই শিশুরা তাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত দেখছে মৃত্যু, মৃতপ্রায় এবং মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা মানুষদের। তারা এখন কোনো কিছুতেই অবাক হয় না, কেবল ক্ষুধা তাদের কাবু করে ফেলেছে। একেবারে কিছুই হয়তো পাবে না সেটা জেনেও তারা সামান্য রেশনের জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছে। শিশুদের ক্ষুধা, তাদের মৃত্যু, মৃত্যুর পর আলতোভাবে তাদের শরীর, কখনোবা শরীরের কিছু অংশ সাদা কাফনে জড়িয়ে দেওয়া- এই সবই এখন গাজার স্বাভাবিক চিত্র হয়ে গেছে।

যদি মৃত শিশুর নাম জানা থাকে তাহলে কাফনের ওপর তাদের নাম লিখে দেওয়া হয়, অনেকেই থেকে যায় অজ্ঞাত। দীর্ঘ ১৯ মাসের এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

সিওয়ার আশৌর নামের পাঁচ মাস বয়সি একটি মেয়েকে খুঁজছিলেন বিবিসির এক প্রতিবেদক। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে মেয়েটির কান্না তার হৃদয় ভেঙে দিয়েছিল। চলতি মাসের শুরুতে ফুটেজ নেওয়ার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। মেয়ে শিশুটির ওজন ছিল মাত্র দুই কেজির একটু বেশি। অথচ পাঁচ মাসের একটি বাচ্চার ওজন হওয়া উচিত ৬ কেজি বা তারও বেশি। তিনি শুনেছেন মেয়েটিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে এখন তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটি অস্থায়ী শিবিরে আছে।

আল মাওয়াইসিতে ওই অস্থায়ী শিবিরে বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রচণ্ড ভিড়। কোন দিকে যেতে হবে সেটা বোঝাই মুশকিল। সেখানেই একটি খুপরি ঘরে সিওয়ার তার মা নাজওয়া এবং নানি রিমের সঙ্গে থাকছে। সিওয়ার ছিল শান্ত। অ্যালার্জির জন্য সাধারণ গুঁড়ো দুধ সে হজম করতে পারে না। যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের অবরোধের কারণে সেখানে শিশুদের প্রয়োজনীয় ফর্মুলার দুধেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ২৩ বছর বয়সি নাজওয়া বলছিলেন, নাসের হাসপাতালে থাকার সময় তার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। কয়েকদিন আগে চিকিৎসকরা এক ক্যান গুঁড়ো দুধ দিয়ে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়। এখন তারা বাড়িতে এসেছে কিন্তু তার ওজন আবার কমতে শুরু করেছে।

সিওয়ার মুখের সামনে মাছি উড়ছিল। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন নাজওয়া। তিনি বলেন, ওর দিকে কীটপতঙ্গ উড়ে আসে। আমি স্কার্ফ দিয়ে ওর মুখ ঢেকে রাখি যেন কিছু স্পর্শ করতে না পারে।

নভেম্বরে জন্মের পর থেকেই যুদ্ধের শব্দের মধ্যেই বাস করছে সিওয়ার। গোলাবারুদ, রকেট, বোমা পড়ছে কাছে এবং দূরে। নাজওয়া বলেন, এগুলো সে বুঝতে পারে। ট্যাংক, যুদ্ধবিমান কিংবা রকেটের বিকট শব্দণ্ডএগুলো আমাদের খুব কাছেই ঘটছে। সিওয়ার যখন এসবের শব্দ শোনে সে কান্না করতে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠে চমকে যায় আর কান্না করতে শুরু করে। চিকিৎসকরা বলছেন, অপুষ্টির কারণে কম বয়সি অনেক মায়েরা তাদের শিশুকে বুকের দুধ পান করাতে পারছে না। এখন বড় সংকট হলো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির। সিওয়ারের জন্মের সময়ই নাজওয়া অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। তিনি ও তার মায়ের জন্য খাবার সংগ্রহ করাই কঠিন হয়ে পড়ছিল। তার মা বলেন যে, সীমান্ত বন্ধ থাকা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় সিওয়ারের জন্য দুধ ও ডায়াপার কেনা যাচ্ছে না।

ইসরায়েলি মিলিটারি সংস্থা কোগাট বলছে, গাজায় কোনো খাদ্য সংকট নেই। তারা বলছে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিশু খাদ্য ও ময়দা সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে পৌঁছেছে। সংস্থাটি বারবার অভিযোগ করছে যে, হামাস ত্রাণ চুরি করছে। অন্যদিকে ইসরায়েল সরকার বলছে, হামাস ধ্বংস ও সব জিম্মি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।

জাতিসংঘ ও ব্রিটেনসহ অনেক দেশের সরকার কোগাটের মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ইসরায়েল যে পরিমাণ সহায়তা নিতে দিচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় এক ?‘চা চামচের’ মতো।

তিনি বলেন, তেল, আশ্রয়, রান্নার গ্যাস ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ফিলিস্তিনিরা এখন নিষ্ঠুর একটি সংঘাতের নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত ধাপে আছে। জাতিসংঘের মতে, গাজার ৮০ শতাংশ জায়গাই হয় এখন ইসরায়েলের সামরিক জোন বা এমন জায়গা যেখান থেকে লোকজনকে সরে যেতে বলা হয়েছে।

গাজার স্কুলে ইসরায়েলের অতর্কিত হামলা, নিহত ২৫ : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় একটি স্কুলে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছে। গাজার চিকিৎসক ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, গাজা সিটিতে গতকাল সোমবার ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুল লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালায়। গাজার উত্তরাঞ্চলীয় শহর বেইত লাহিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া শত শত ফিলিস্তিনি ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেই হামলা চালায় ইসরায়েল। গাজায় হামাস পরিচালিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার একজন মুখপাত্র বলেছেন, স্কুলটি থেকে ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। তবে এই হামলা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েলি বাহিনী।

গাজা নিয়ে ‘সুসংবাদের’ ইঙ্গিত দিলেন ট্রাম্প : গাজার পরিস্থিতি নিয়ে শিগগির ইতিবাচক অগ্রগতির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একইসঙ্গে, ইরানের পারমাণবিক আলোচনা নিয়েও আশাবাদ প্রকাশ করেছেন তিনি। গত রোববার নিউ জার্সি থেকে এয়ার ফোর্স ওয়ানে ওঠার আগে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, আমার মনে হয়, ইরান নিয়ে কিছু ভালো খবর আসতে পারে, গাজা এবং হামাস নিয়েও। তিনি আরও বলেন, আমরা দেখতে চাই, এটি বন্ধ করা যায় কি না, আর ইসরায়েলের সঙ্গেও আমরা কথা বলছি। পুরো পরিস্থিতিটাই থামানো যায় কি না, সেটা আমরা দেখতে চাই।

ট্রাম্পের এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এলো যখন গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অভিযান নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে। গাজায় বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হওয়া একটি স্কুলে রোববার ইসরায়েলি বোমা হামলায় ২৫ জন নিহত হয়েছেন। দখলদার বাহিনীর হামলায় রেড ক্রসের দুই কর্মী, এক সাংবাদিক এবং বেশ কয়েকজন শিশুও প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজায় ৭০ হাজারের বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টির সম্মুখীন। এরই মধ্যে চার বছর বয়সি মোহাম্মদ ইয়াসিন নামের একটি শিশু খাদ্যের অভাবে মারা গেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বুধবার থেকে ইসরায়েল গাজায় মাত্র ১০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। গাজায় যে পরিমাণ খাদ্য সরবাহ করা প্রয়োজন তার তুলনায় এটা খুবই সামান্য। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় অন্তত ৫৩ হাজার ৯৩৯ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ২২ হাজার ৭৯৭ জন আহত হয়েছে। তবে সরকারি গণমাধ্যম মৃতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০-এর বেশি বলে জানিয়েছে। কারণ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ এখন আর বেঁচে নেই বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গাজার মানবিক সহায়তা সংস্থার প্রধানের পদত্যাগ : গাজায় ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলের উদ্যোগে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি বেসরকারি মানবিক সংস্থার প্রধান জ্যাক উড পদত্যাগ করেছেন। গত রোববার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। গত দুই মাস ধরে গাজা হিউমেনিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জ্যাক উড। পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, ‘এই সংস্থা মানবতা, নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা এবং স্বাধীনতার নীতিগুলো মেনে চলতে পারছে না, যা তিনি কখনও পরিত্যাগ করবেন না।’ উডের বিবৃতিতে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয়নি। পদত্যাগ বিষয়ে রয়টার্সের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়াও দেননি সাবেক এই মার্কিন মেরিন কর্মকর্তা। এক বিবৃতিতে ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদ বলেছে, উডের পদত্যাগে তারা হতাশ, তবে গাজা উপত্যকার পুরো জনগোষ্ঠীর কাছে সহায়তা পৌঁছানোর প্রচেষ্টা থেকে তারা সরে আসবে না। বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের ট্রাকগুলো প্রস্তুত এবং রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি। সোমবার থেকে সংস্থাটি সরাসরি গাজায় ত্রাণ সরবরাহ শুরু করবে এবং সপ্তাহ শেষের আগেই ১০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির কাছে পৌঁছাবে বলে জানায় তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত