বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানো না হলে আবারও কঠিন আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তার সমর্থকরা। এর আগে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেছিল তারা। সেই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি আদায় না হওয়ায় ফের আন্দোলনে নেমেছেন তারা। এবার তারা কঠোর আন্দোলনের হুঁশিযারিও দিয়েছেন। গতকাল সোমবার নগর ভবনের ভেতরের ফটকে ‘অবস্থান কর্মসূচি’ থেকে সাবেক সচিব মশিউর রহমান বলেছেন, ‘আমরা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলাম; কিন্তু দাবি মেনে নেওয়া হয়নি। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে মেয়রের শপথ পড়ানো না হয়, তাহলে আবারও কঠিন থেকে কঠিনতর আন্দোলনে নামব। আন্দোলনের মাধ্যমে ঢাকাবাসী তাকে মেয়রের পদে বসাবে। মশিউর রহমান আরও বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চলাকালে সরাসরি নাগরিকসেবার সঙ্গে সম্পর্কিত পরিচ্ছন্ন বিভাগের কাজ চলবে। এই বিভাগের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাদের মালামাল নিতে পারবেন। অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশনের জরুরিসেবার কাজটি চলমান থাকবে।
ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে গতকাল সোমবার বেলা ১১টা থেকে নগর ভবনের ভেতরের ফটকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তার সমর্থক ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মচারীরা। এতে নগর ভবনে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের নাগরিকসেবা। ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। গতকাল সকালে নগর ভবনের ভেতরের ফটকে অবস্থান নিয়ে ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন’ ও ‘ঢাকাবাসী’র ব্যানারে কর্মসূচি চালিয়ে যান তারা। অবস্থানকারীরা ফটকে তালা লাগিয়ে রেখেছেন। এতে সেবাপ্রার্থীরা সেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন, আদালতের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট সত্ত্বেও এখনও কেন ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে দেওয়া হয়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. বেলায়েত হোসেন বাবু বলেন, দুই দফায় আদালত রায় দিয়েছেন, এরপরও ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব নিতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা তার শপথ ও দায়িত্ব গ্রহণের দাবিতে আন্দোলনে আছি। অন্য এক কর্মচারী বলেন, জনগণের মেয়র ইশরাককে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এখান থেকে যাব না। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা তাকে মেয়র হিসেবে দেখতে চাই। এদিকে, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে লিভ টু আপিল করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিলটি (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) দায়ের করা হয়। ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় এবং ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিট সরাসরি খারিজ করে ২২ মে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এই আদেশের বিরুদ্ধে মেয়র ঘোষণা ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে আজ লিভ টু আপিল করেন রিট আবেদনকারী।
লিভ টু আপিলকারীর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় এবং ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে লিভ টু আপিলটি দায়ের করা হয়েছে। আজ চেম্বার আদালতে শুনানি হতে পারে।’
ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় এবং ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে মো. মামুনুর রশিদ নামে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ১৩ মে রিটটি করেন। শুনানি নিয়ে ২২ মে হাইকোর্ট রিট সরাসরি খারিজ করে আদেশ দেন। সেদিনই পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশিত হয়। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে গতকাল লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়।
মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে আজকের (গতকাল সোমবার) মধ্যেই শপথ পড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গতকাল সোমবার ইশরাকের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এ নোটিশ পাঠিয়েছেন।
এদিকে, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নগর ভবনে তালা দেওয়ায় নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী। অনতিবিলম্বে নগর ভবনের তালা খুলে দিয়ে নাগরিকসেবা স্বাভাবিক করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষুব্ধ নগরবাসীর ব্যানারে এক মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, সরকারকে অনুরোধ করব, নগর ভবনের তালা খুলে দিয়ে আমাদের সেবা নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
এটা আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করে দিতে হবে। যারা নগর ভবন অবরুদ্ধ করে আন্দোলন করেছেন তাদের উদ্দেশে বক্তারা বলেন, এভাবে নগর ভবনে তালা লাগানো অবৈধ। আপনারা তালা খুলে দেন।
অবিলম্বে আপনারা নগর ভবন ছেড়ে দেন। আমাদের আর ভোগান্তিতে ফেলবেন না। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়।
আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। একই বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে ইশরাকের করা নির্বাচনি মামলায় চলতি বছরের ২৭ মার্চ রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। রায়ে তাপসকে নির্বাচিত ঘোষণা বাতিল করা হয়। ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করা হয়। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
প্রসঙ্গত, ১৪ মে থেকে এই আন্দোলন শুরু হয়। টানা ১৩ দিন ধরে আন্দোলন চলে। মাঝে দাবি পূরণের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। এরপর আবারও আন্দোলন শুরু হয়। সরেজমিন দেখা যায়, নগর ভবনের ফটকগুলোয় তালা ঝুলছে। ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন’ ও ‘ঢাকাবাসী’র ব্যানারে ইশরাকের সমর্থকরা নগর ভবনের ভেতরের ফটকে অবস্থান নিয়েছেন। এ সময় ‘দাবি মোদের একটাই, মেয়র ছাড়া অফিস নাই’, ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘রাজপথের ইশরাক ভাই, আমরা তোমায় ভুলি নাই’ স্লোগান দিতে শোনা যায়।