বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তাল রয়েছে সাগর। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দিনভর ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি ও মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। মহেশখালীর কুতুবজোমে জোয়ারের পানিতে ডুবে দানু মিয়া (৪২) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করা নিম্নচাপের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এতে কক্সবাজারসহ চার সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সাগরে অবস্থানরত সব ধরনের নৌযানকে নিরাপদে আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আবদুল হান্নান জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে ৯২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী শনিবার পর্যন্ত আবহাওয়া পরিস্থিতি এরকম থাকতে পারে। সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সতর্ক করে সৈকতে লাল পতাকা উঁচিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের বিচকর্মীদের সহকারী সুপারভাইজার বেলাল হোসেন জানান, উত্তাল সাগরে গোসল থেকে বিরত থাকতে মাইকিং করে পর্যটকদের সর্তক করা হচ্ছে। ভাঙা বেড়িবাঁধে পানি ঢুকে ২০ গ্রাম প্লাবিত। জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফ সমুদ্র উপকূলের অন্তত ১৫টি এলাকায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে কমপক্ষে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি দ্বীপ উপজেলার কুতুবদিয়ার। এ দ্বীপের দক্ষিণে আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নে কবি জসীম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে বেড়িবাঁধ লাগোয়া বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প। বিদ্যুৎ প্রকল্প ভবনের দক্ষিণ পাশে ৫০ মিটারের মতো ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে। এতে এ ইউনিয়নের পূর্বপাড়া, সন্দ্বীপপাড়া, হাইস্কুল পাড়া ও শান্তি বাজার এলাকা অন্তত তিনফুট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
পাশের কৈয়ারবিল ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান শফিউল আলম কুতুবী জোনান, তার ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধসংলগ্ন মৌলভী পাড়া ও মফজল আহমদ পাড়ার অন্তত ২০০ বাড়িতে পানি ঢুকেছে।
একইভাবে উপজেলার উত্তর ধুরং ইউনিয়নের মিয়ারাকাটা ও দক্ষিণ ধুরংয়ের বাতিঘর পাড়া এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ।
কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্যথোয়াইপ্রু মারমা বলেন, বায়ুবিদ্যুৎ এলাকার বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ওঠাণ্ডনামা করছে। দ্বীপের ৭-৮ পয়েন্টে বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব ভাঙা অংশ দ্রুত মেরামত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কুতুবদিয়ায় উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরি সভা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্যথোয়াইপ্রু মারমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হওয়া ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। যেসব গ্রামে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে সেসব এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি সব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জামাল মোর্শেদ জানান, ‘কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১৫টি ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের ধাক্কায় পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে। চার দিন ধরে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বৈরী আবহাওয়ায় সাগর উত্তাল থাকায় চার দিন ধরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সঙ্গে টেকনাফের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে করে দ্বীপের বাসিন্দারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকটে পড়েছে। ’
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটের সার্ভিস ট্রলার সমিতির সভাপতি রশিদ আহমদ জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চার দিন ধরে সবধরনের নৌচলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে পণ্যবাহী ট্রলারও বন্ধ রয়েছে।
নৌযান বন্ধ থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে বলে জানান সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম। তিনি জানান, দ্বীপে কাঁচাবাজার ফুরিয়ে এসেছে। অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আজকালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে তাও দাম চড়া। এ অবস্থায় দ্বীপের মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘বৈরী আবহাওয়ায় সাগর উত্তাল রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ৩ নম্বর সর্তক সংকেত জারি করেছে। এ কারণে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নৌযান চলাচল করতে পারবে। পাহাড় ধসের সতর্কবার্তা। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়ে ৩৩টি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির রয়েছে। এসব আশ্রয়শিবিরে অন্তত ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা পাহাড়ের ঢাল ও নিচে ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে বাস করেন।
এছাড়া জেলার সদর, ঈদগাঁও, রামু, চকরিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়ায় লাখো পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। প্রতিবছর বর্ষায় বৃষ্টিতে এসব এলাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
উত্তাল সাগরের ঢেউ আঘাত আনছে ঝাউবাগান ও জিওব্যাগে : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে একের পর এক বিশাল বিশাল ঢেউ আঘাত হানছে ঝাউবাগানে ও জিওব্যাগে। ফলে সাগরপাড়ার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে উপকূলে উঠিয়ে রাখা হয়েছে জেড স্কি ও কিটকট।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় দেখা যায়, সাগর উত্তাল। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে জিওব্যাগ ডিঙিয়ে আঘাত করছে ঝাউবাগানে। আবার জিওব্যাগের ওপর বসে থাকা পর্যটকও ঢেউয়ের আঘাতে পড়ে যাচ্ছে। অনেক পর্যটক পানিতে নামতে চাইলেও বড় বড় ঢেউ দেখে নামছে না। অনেকেই বড় বড় ঢেউ পেছনে রেখে ছবি তুলে চলে যাচ্ছেন। অনেক পর্যটক উত্তাল সাগর উপভোগ করছেন দূর থেকে।
ঢাকা থেকে আগত পর্যটক রশিদ আহমেদ বলেন, গত দুই দিন ধরে কক্সবাজারে। কিন্তু সাগর এতো উত্তাল ছিল না। আজকে দেখছি সাগর প্রচণ্ড উত্তাল। সাগরে গোসলে নামার উপায় নেই। মনে হচ্ছে সাগরে নামলেই ঢেউ আঘাত করে নিয়ে যাবে।
আরেক পর্যটক মোহাম্মদ এমদাদ বলেন, এমন সাগর আগে কোনো দিন দেখা হয়নি। এতো বড় বড় ঢেউ, সাগরের এমন সৌন্দর্য দূর থেকে খুবই উপভোগ করছি। তবে গোসল করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লাইফ গার্ড কর্মীরা নামতে দেয়নি।
সৈকতের লাইফ গার্ড কর্মী মোহাম্মদ শুক্কুর বলেন, জোয়ারের সময় সাগর বেশি উত্তাল। পানির উচ্চতা ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই অনেক পর্যটক সাগরে গোসল করতে নামতে চাইলেও সাগর উত্তাল থাকায় কাউকে নামতে দেয়া হচ্ছে না। ট্যুরিস্ট পুলিশ, লাইফ গার্ড ও বিচ কর্মী সবাই একযোগে কাজ করছি। পর্যটকদের নিরাপত্তায় সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন সৈকতপাড়ের জেড স্কি, বিচ বাইক, ফটোগ্রাফার ও কিটকট ব্যবসায়ীরা। সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে জেড স্কি উপকূলে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে উঠিয়ে রাখা হয়েছে পর্যটকদের বসার কিটকটও (ছাতা)। পর্যটক কম থাকায় ব্যবসা হচ্ছে না ফটোগ্রাফার ও বিচ বাইক চালকদের।
জেড স্কি চালক ফরমান বলেন, সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ। যার কারণে জেড স্কি উপকূলে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যবসা এক প্রকার বন্ধ।
কিটকট ব্যবসায়ী রানা বলেন, লাবনী থেকে সুগন্ধা ও শৈবাল পয়েন্ট পর্যন্ত কয়েকশ’ কিটকট বালুচর থেকে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। এখন ব্যবসা বন্ধ করে নিরাপদে বসে আছি। এদিকে বেলা ১১টার পর শুরু হয় তুমুল ঝড়ো বৃষ্টি। পর্যটকরা ছুটতে থাকা দিকবিদিক। অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজছে, অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয় বাতাসও। বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ময়লা আবর্জনাও। আর গাছপালাও ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। চারিদিকে মেঘাচ্ছন্ন।
মহেশখালীতে জোয়ারের পানিতে ডুবে একজনের মৃত্যু : কক্সবাজারের মহেশখালীতে জোয়ারের পানিতে ডুবে দানু মিয়া (৪০) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা একটার দিকে উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত দানু মিয়া ওই এলাকার নুর হোসেনের ছেলে। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় ঘটিভাঙা বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে দানু মিয়া জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গিয়ে দানু মিয়া নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গত বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলায় অতি ভারি বর্ষণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে।