ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নির্বাচনি প্রচারণায় বিলবোর্ড অনুমোদন পরিবেশ বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত

মো. তাহমিদ রহমান
নির্বাচনি প্রচারণায় বিলবোর্ড অনুমোদন পরিবেশ বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধি সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন যে খসড়া অনুমোদন দিয়েছে তাতে বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়েছে। সংশোধনীতে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু নির্বাচনি প্রচারে বিলবোর্ড ব্যবহারের বিষয়টির অনুমোদন যেকোনো নাগরিকের কপালে চিন্তার ভাঁজকে জাগিয়ে তুলবে। এমনিতেই বিজ্ঞাপনের রসায়নে সমৃদ্ধ হতে নগ্ন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি সবাই। এতটাই বেড়ে গেছে বিজ্ঞাপনের ব্যানার যেটা নান্দনিকতাকে ছাপিয়ে আমজনতার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে নির্বাচনি প্রচারণায় বিলবোর্ড অনুমোদন যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা।

দেশের বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনগুলো শতভাগ পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারে তৈরি করা হয়। কে নেই বিজ্ঞাপন ব্যানারের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস প্রাঙ্গণ সর্বত্রই বিজ্ঞাপন ব্যানারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। নিকটাতীতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিক রসায়নকে হৃষ্টপুষ্ট রাখতে আজকাল অনেক দল ও ব্যক্তির চিন্তা-চেতনাই যেন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বিজ্ঞাপনে নিজের বড় বড় ছবি প্রদর্শন করে রাষ্ট্রবিপ্লবের অংশীজন হতে হবে।

ঈদ, পূজা, পার্বণ, মিছিল, সমাবেশ, জন্মদিন, মিটিং, কনফারেন্স এবং এমন কোনো জাতীয় দিবস নেই যে আমরা অসহায় জনগণ শুভেচ্ছা ব্যানারের বন্যায় ভেসে যাই না! ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষত মোবাইল অপারেটর ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানসমূহের পিভিসি ফ্লেক্স বিজ্ঞাপনে ধরাশায়ী আমরা ক্রেতাকুল। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের গলায় সফলতার বরমাল্য নিয়ে বড় বড় ছবি দিয়ে ঢাউস আকৃতির ব্যানার ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে সড়ক-মহাসড়কে মোড়ে মোড়ে। জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করুক বা না করুক, সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিদের এসব রাজনৈতিক রসায়নে হৃষ্টপুষ্ট ব্যানার ঝোলানো চাই চাই। সেসব ব্যানারে আবার লক্ষ্য করা যায়, প্রাণ উজাড় করা অঢেল শুভকামনা, যদিও বেশির ভাগই স্বার্থান্বেষী, মেকি, ধান্দাবাজির মতলব। কিন্তু কি করার আছে আমাদের মতো আমজনতার। এ যেন আমাদের সর্বনাশ দেখে তাদের পৌষ মাস! বাণিজ্যিক প্রচার কিংবা তেলবাজি রাজনীতিতে নিজেকে জাহির করা, যে উদ্দেশ্যেই তৈরি হোক এসব বিপজ্জনক ফ্লেক্স ব্যানার সবই পরিবেশবিধ্বংসী।

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১ অক্টোবর থেকে পলিথিন, পলিপ্রপিলিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ যদিও মাঠপর্যায়ে বাস্তবতা ভিন্ন। এর আগেও ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ আইন করে বিষাক্ত পলিথিন ব্যাগ এবং একবার ব্যবহারযোগ্য ভার্জিন প্লাস্টিকসামগ্রী উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগ বাহিনীর অবহেলা এবং জনসাধারণের অসচেতনতায় পলিব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার কমেনি; বরং গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ধারাবাহিক তদারকি না করে হ্যালির ধূমকেতুর মতো বছরে দুই একবার ঝটিকা অভিযান চালালে এসব একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনসামগ্রীর ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়। পলি ভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) এক ধরনের থার্মোপ্লাস্টিক। পিভিসির অনেক ধরনের পণ্যের মধ্যে একটা হলো পিভিসির ওপর ফ্লেক্সিবল পলিস্টারের কোটিং দেওয়া বিজ্ঞাপন ব্যানার, যা পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার বা ডিজিটাল ব্যানার নামে পরিচিত। বিজ্ঞাপনে চতুর্দিকে নিজেদের জয়গান গেয়ে যে ডিজিটাল বাহারি পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলো; কিন্তু প্লাস্টিক পণ্য, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। দেখতে সুন্দর হলেও ভয়াবহ বিষাক্ত জিনিস হলো পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার। দাম কম ও সহজলভ্য হওয়ায় পিভিসির ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে এবং যত্রতত্র পিভিসি বর্জ্য বাড়ছে ভয়ানক গতিতে।

এসব পিভিসি ফ্লেক্স তৈরি করতে গিয়ে উৎপাদন কারখানাগুলো প্রচুর পরিমাণে সলিড বর্জ্য তৈরি করছে। পাশাপাশি নানা রকম বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে পানি, বায়ু ও পরিবেশকে দূষিত করছে। পিভিসি উৎপাদনের কারণে পারদ বাষ্প আকাশে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই পারদ আবার মাটিতে ফিরে আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে। মাটিতে ফিরে আসা পারদ মিথাইলেশন ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা মিথাইল মার্কারিতে পরিণত হচ্ছে। মিথাইল মার্কারি খুবই বিষাক্ত নিউরো টক্সিন। যার কারণে মানব শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়াসহ হজমে সমস্যা, কিডনি রোগ, অটিজমসহ নানারকম স্নায়ুবিক রোগ দেখা দিচ্ছে।

পিভিসি তৈরিতে উপজাত হিসেবে ভিনাইল ক্লোরাইড উৎপাদিত হয়, যার কারণে ব্যাপক হারে মানব শরীর টিউমার, ফুসফুসের ক্যানসার, লিম্ফোমাস, লিউকোমিয়া ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হচ্ছে। পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ও পিভিসির তৈরি বর্জ্য পুড়িয়ে ফেললে ফুরান ও ডাই অক্সিন নামক রাসায়নিক দূষণ ঘটে। এই রাসায়নিকগুলো রোদ, বৃষ্টি, বাতাস, মাইক্রোবিয়াল অ্যাকটিভিটি কিছুই ধ্বংস করতে পারে না অর্থাৎ এরা প্রায় অবিনশ্বর। দুঃখের বিষয়, পরিবেশ দিবসের সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানগুলোও হাস্যকরভাবে উপস্থাপিত হয় পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক সময় রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় সয়লাব হয়ে গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিজেদেরকে জাহির করার শুভেচ্ছা ব্যানারে। এটা একই সঙ্গে পরিবেশবিধ্বংসী ও দৃষ্টিকটু। এসব বিপজ্জনক পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারের সংখ্যা হয়তো বাড়িয়ে তুলবে আগামী ভোটের মৌসুম।

বর্তমানে এসব ডিজিটাল ব্যানারগুলো যেখানে-সেখানে লাগানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না সরকারি-বেসরকারি ভবন এমনকি সড়কের দুধারের গাছও। ফলে ব্যাপকহারে দেশবাসী উপহার পাচ্ছে দূষণসামগ্রী।

প্লাস্টিকের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হলেও পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার সর্বত্র বিরাজমান কেন? এটাও তো প্লাস্টিকের তৈরি একটি বিপজ্জনক পণ্য। পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারগুলো প্লাস্টিক ব্যাগের মতোই একই উপকরণ দিয়ে তৈরি এবং অপচনশীল।প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপন্ন হয় পলিথিন থেকে এবং ফ্লেক্স ব্যানার উৎপন্ন হয় পলিভিনাইল ক্লোরাইড থেকে। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত মোট প্লাস্টিকের পরিমাণগত দিক দিয়ে পলি ভিনাইল ক্লোরাইড তৃতীয় বৃহৎ উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্য। উন্নত বিশ্ব তো বটেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কাতেও পরিবেশের কথা চিন্তা করে পিভিসি ফ্লাক্স ব্যানার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পৃথিবীতে নিজেদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এখনই নির্বাচন কমিশন তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত নির্বাচনী প্রচারণায় বিলবোর্ডের অনুমোদন বাতিল করে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধি সংশোধন খসড়ার পরিবর্তন আনা। যেহেতু খসড়া আচরণবিধিতে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহারের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। তাই বিলবোর্ড ব্যবহার বন্ধ না করলে নির্বাচনী পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। পরম পরিতাপের বিষয় যে এ ধরনের পরিবেশ বিধ্বংসী একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো অথচ কোনো রাজনৈতিক দল এখনো এটার বিরোধিতা করলোনা। তবে কি সুদিনের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে তার সবকিছুই মেকি।

নির্বাচনি প্রচারণাসহ সকল ধরনের প্রচারণায় বিলবোর্ড ব্যবহার বন্ধ না করলে নির্বাচনি পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আগামী নির্বাচনে যে কোনো উপায়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সুস্থ্যধারার আনন্দ-উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকা জরুরি। এ কাজে যত রকমের সংস্কার ও সংশোধন প্রয়োজন তাতে যেন দেশের রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ মহল, নাগরিক সমাজ ও তরুণ সমাজের মতামত উপেক্ষিত না হয়।

আমরা আশাবাদী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুতই বিলবোর্ডে প্রচার তথা পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার উৎপাদন বন্ধে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় সকল স্তরের জনগণকেও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা রইল, সব স্তরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে প্রতিবেশ ও পরিবেশ রক্ষায় নির্বাচনি প্রচারণায় বিলবোর্ডে পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারের ব্যবহার প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত