ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরায় গ্রাহকরা ঘরের টাকা ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছেন। এতে বেড়েছে ব্যাংকের আমানত। ঋণ দেওয়ার মতো তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয় ব্যাংক খাতে। এতে এই খাতের ওপর জনসাধারণের আস্থা অনেকটা কমে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক মার্জের (একীভূতকরণ) খবর এবং জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের প্রভাবে অনেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। এখন সেই টাকা আবার ফিরতে শুরু করেছে। ইতিবাচক প্রতিফলন দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে।
গতকাল শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা পরিষদে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়িয়ে দিলে সবাই সঞ্চয়পত্র কিনবে, তখন কেউ আর ব্যাংকে টাকা রাখবে না। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে লিকুইডিটির একটা ব্যাপার আছে। আমাদের ব্যালেন্স করে দেখতে হবে। সবাই সঞ্চয়পত্র কিনলে ব্যাংক কোথায় টাকা পাবে?’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করা যাবে কি না এমন প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের টাকা-পয়সা নিয়ে অনেকেই বিদেশে চলে গেছে। এরকম ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি। ব্যাংক খাতে কিছু সংস্কার সময়সাপেক্ষ, এটা আমরা করতে পারব না। এটা নির্বাচিত সরকার এসে করবে।’ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আর্থিকভাবে দুর্বল ১২টি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ৫২ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে। এর আগে আরও ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এগুলো স্থায়ী সমাধান নয়। আমরা চেষ্টা করছি মাত্র।’ ব্যাংকগুলোর পুনর্বাসনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে। ইসলামী ব্যাংক এখন একটা বড় উদাহরণ প্রাইভেট সেক্টরের এই ব্যাংকে আস্থা ফিরে এসেছে। অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষেত্রেও সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষেত্রে একটা আইন হয়েছে, ব্যাংক রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট। এই আইনের প্রথম শর্ত হলো যারা ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছে, তাদের টাকা ফেরত দিতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। হয়তো সময় লাগবে, তবে কারো টাকা মার যাবে না।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ মার্চের তুলনায় কমেছে প্রায় ১৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর আগে মার্চে হঠাৎ করে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, যা মূলত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট ও দুর্নীতির আশঙ্কায় ছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়িতে রাখতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চে যেখানে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি ৬ লাখ টাকা, সেখানে এপ্রিল মাসে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এক মাসে প্রায় ১৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যাংকে ফিরে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের হাতে নগদ অর্থ কমে যাওয়ার অর্থ হলো মানুষ আবার ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের তারল্য বাড়বে, যা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতেও টাকার প্রবাহ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে বাজারে ছাপানো টাকার পরিমাণ বা রিজার্ভ মানি কমেছে ২২ হাজার ৮৮ কোটি ১ লাখ টাকা। মার্চে রিজার্ভ মানি ছিল ৪ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ৬ লাখ, যা এপ্রিল মাসে কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৪৫ কোটি ৫ লাখ টাকায়।
একই সময় বাজারে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণও কমেছে। মার্চে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৬০ কোটি ৮ লাখ টাকা, যা এপ্রিল মাসে কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ২ হাজার ৬৮৪ কোটি ২ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এক মাসে কমেছে ১৮ হাজার ৪৭৬ কোটি ৬ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিক তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার প্রবণতা ছিল নিম্নমুখী। ২০২৩ সালের আগস্টে এই পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকা, যা সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। সেপ্টেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ, অক্টোবরে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি ৭ লাখ, নভেম্বরে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি ৭ লাখ, ডিসেম্বরে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭১ কোটি ৫ লাখ, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৩০ কোটি ৯ লাখ এবং ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। এর বিপরীতে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এরপর নভেম্বরে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি, ডিসেম্বরে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি, মার্চে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি, এপ্রিল ও মে মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি এবং জুনে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকায়। জুলাইয়ে হয় ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৩০ কোটি এবং আগস্টে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকায় পৌঁছায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখতেন। পাশাপাশি কিছু ব্যাংক নিয়ে অনাস্থার কারণে অর্থ গচ্ছিত রাখার নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে অনেকেই বাড়িকে বেছে নিয়েছিলেন। তবে এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ফেরায় মানুষ আবার ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন।