জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় উত্তর-পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ ও বীজ উৎপাদন খামারটি মৎস্য বীজ উৎপাদনে সফলভাবে ফিরেছে। জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় অবস্থিত মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার এর ব্যবস্থাপক মো. আব্দুস সালাম প্রামানিক এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, এক সময় জনবল স্বল্পতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল এই মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারটি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উদ্যোগের কারণে এখানে দেশের সাদা সোনাখ্যাত গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে স্থানীয় ১ হাজার ২০০ চাষি মাছ চাষে সফলতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
তিনি জানান, ১৯৬৪ সালে ৫০ একর জমি ওপর মৌসুম বীজ উৎপাদন খামারটি স্থাপিত হয়ে ছিল। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় খামারটি আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর ও জেলা মৎস্য অফিসের দীর্ঘ পরিকল্পনায় খামারটি এখন দেশের আদর্শ মৎস্য-বীজ উৎপাদন খামারে পরিণত হতে চলেছে। খামার সূত্রে জানা যায়, এ খামারে রয়েছে মাছের পোনা উৎপাদনের জন্য ৪৬টি পুকুর। রয়েছে আধুনিক মানের প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স। এখানে কার্প-জাতীয় রুই, কাতলা, সিলভার, বিগ হেড, গ্রাস-কার্প, কালিবাউস, বাটা ও দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, কই, গুলসা টেংরা ও পাবদার পোনা সফল-ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে।
খামার সূত্রটি আরো জানায়, গত ২০০০ সালের ২৭ অক্টোবর তৎকালীন মৎস্য ও পশু-সম্পদ মন্ত্রী এই প্রকল্প কমপ্লেক্সের গলদা চিংড়ি হ্যাচারির উদ্বোধন করেছিলেন। এর পর চলতি বছর এবারই প্রথম জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে পার্বতীপুর উত্তর-পশ্চিম মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার থেকে জেলার ১৩টি উপজেলায় প্রায় পাঁচ মেট্রিক টন পোনা সরবরাহ করা হয়েছে। আর এতে গলদা চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। পার্বতীপুর উপজেলার বেলাইচণ্ডী গ্রামের মাছ চাষি আমজাদ হোসেন বলেন, মাছ চাষ করে আমি জীবিকা নির্বাহ করি। বর্তমান মাছের বাজার-দর ভালো আছে। আগে মাছের পোনা আমাদের এই অঞ্চলে তেমন পাওয়া যেত না। বাইরের জেলা থেকে বিভিন্ন মাছের পোনা সংগ্রহ করে ৪টি পুকুরে চাষ করতাম। বাইরে থেকে পোনা আনায় খরচ বেশি হতো। বর্তমানে পার্বতীপুর মৎস্য সম্প্রসারণ ও বীজ উৎপাদন খামারের সহযোগিতায় এখন আমরা সব ধরনের মাছের পোনা সহজে পাচ্ছি। চিরিরবন্দর উপজেলার রাজারামপুর গ্রামের মাছ চাষি মো. আবেদ আলী জানান, পার্বতীপুর মৎস্য সম্প্রসারণ ও বীজ উৎপাদন খামার থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করে এবার ৫টি পুকুরে মিশ্র জাতের মাছ চাষ করেছি। এই খামারের উৎপাদিত পোনার মান খুব ভালো। খামার কর্তৃপক্ষ মাছ চাষিদের সঠিকভাবে পরামর্শ দিয়ে সব সময় সহযোগিতা করে। তবে বর্তমানে বাজারে মাছের খাদ্যের দাম অনেক বেশি। খাদ্যের দাম একটু কমালে আমরা মাছ চাষে আরও লাভবান হতাম। এক সময় ধারণা করা হয়েছিল, এই অঞ্চলের মাটি ও পানি চিংড়ি চাষের উপযুক্ত নয়। কিন্তু খামারে সফল গলদা চিংড়ি বীজ উৎপাদন এই অঞ্চলে চিংড়ি চাষে আগ্রহের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০২৪ সালের কর্মণ্ডপরিকল্পনায় এই খামারে সাড়ে ৪ লাখ পিস গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। এই তথ্য নিশ্চিত করেন, খামারের ব্যবস্থাপক মো. আব্দুস সালাম প্রামানিক। তিনি আরো বলেন, খামারটি দেশের মধ্যে আদর্শ খামারে পরিণত করার লক্ষে মাছের পোনা উৎপাদনে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। এই খামারে শুধু গলদা চিংড়ি নয়, যেন সাদা সোনা উৎপাদিত হচ্ছে। খামার ব্যবস্থাপক বলেন, গলদা চিংড়ির পিএল (পোস্ট লার্ভা) উৎপাদনের ক্ষেত্রে জীবন-চক্রের শুরুতে নোনা পানির দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে নোনা পানি সংগ্রহ করে স্বাদু পানি বা মিঠা পানির সঙ্গে খাপ খাইয়ে, পিএল উৎপাদন করা হয়।
উৎপাদনের ক্ষেত্রে বরগুনা জেলার আমতলীর পায়রা নদী থেকে গলদা চিংড়ির মা মাছ সংগ্রহ করে আনা হয়। মা মাছ থেকে লার্ভা সংগ্রহ করে ২৮ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে পিএল উৎপাদন করা হয়। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম রেজাউল করিম বলেন, এ অঞ্চলে দেশীয় মাছ গুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমন মুহূর্তে এ খামারে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন শুরু করা হয়েছে। এসব পোনা মাছ চাষি পর্যায়ে চাষ করাতে চাষিদের জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে। এ ছাড়া খামারে গলদা চিংড়ির পিএল উৎপাদন করা হয়। লোকবল স্বল্পতা নিয়ে খামারে সব কাজ সফলভাবে করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রংপুর বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, পার্বতীপুর উত্তর-পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ ও বীজ উৎপাদন খামারের বর্তমান মাছ চাষ অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। অব্যস্থাপনায় এক সময় খামারটি মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনার পর এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি বলেন, গলদা চিংড়ির উৎপাদনে আমরা ব্যাপক সফলতা পেয়েছি। বর্তমানে এ খামার থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ মাছ-চাষি পোনা নিয়ে গিয়ে মাছ চাষ করছেন। আবার চাষি পর্যায়ে গলদা চিংড়ি ও দেশি প্রজাতির মাছ চাষ করতে বিভিন্ন কর্মশালার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এভাবে দেশি মাছের সংকট দূর করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।