ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গার্মেন্ট সেক্টরে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ

গার্মেন্ট সেক্টরে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ

নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে দিন দিন অসন্তোষ বেড়েই চলছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর এর হঠাৎ করে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অভিযোগ রয়েছে কিছু শ্রমিকনেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গার্মেন্টস কর্মীদের মধ্যে নতুন করে অনেকে নেতা বনে গেছেন। কোন শ্রমিক নিয়মিত ডিউটিতে না আসলে গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ কৈফিয়ত চাইলেই ওই শ্রমিক নেতারা গার্মেন্টসে গন্ডগোল বাঁধিয়ে দিয়ে নিরীহ শ্রমিকদের হুমকি-ধামকি দিয়ে রাস্তায় নিয়ে আসে। ফলে গার্মেন্টস সেক্টরে পাতি শ্রমিক নেতাদের কারণে দিনে দিনে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে ৮ শতাধিক রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায় ১৫ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। এরমধ্যে অধিকাংশ পোশাক কারখানা ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত। ফতুল্লার বিসিক এর শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকায় দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নিচ্ছে, শ্রমিক সেজে হামলা করছে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠী নানা দাবিতে মাঠে নেমেছে। পোশাক শ্রমিকদের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট নয়। একেক কারখানায় একেক ধরনের দাবি উঠছে।

কোনো কোনো কারখানায় সমানুতিক হারে নারী-পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ, মাতৃত্বকালীন ভাতা, নাইট ভাতা এবং যেকোনো ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য বিক্ষোভ করা হয়। এটা মূলত বহিরাগতদের কাজ বলেই মনে করেন কারাখানা সংশ্লিষ্টরা। তথ্যানুসারে, মামলার প্রত্যাহার, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ ও লে-অফ ঘোষণা করা কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে গত বুধবার দুপুর ২টা থেকে ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকায় নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ইউরোটেক্স নিটওয়্যারের শ্রমিকরা। এতে করে ওই সড়কে অসংখ্যক যানবাহন আটকা পড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। চরম র্দুভোগের শিকার হয় যাত্রী সাধারণ। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি গিয়ে শ্রমিকদের শান্ত করেন। এবং শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেয়।

শ্রমিক ও পুলিশ জানায়, সদর উপজেলার ফতুল্লার নয়ামাটি এলাকার রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ইউরো টেক্স নিটওয়্যার লিমিটেডে প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করে। শ্রমিকেরা গত ১১ ফেব্রুয়ারি এক মাসের বকেয়া বেতন, ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ করে আসছিল। শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কারখানার কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম বাদী হয়ে চাকরিচ্যুত ২৮ শ্রমিককে আসামি করে ফতুল্লা মডেল থানায় ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা দায়ের করে। এরপর থেকে কারখানার শ্রমিকরা মামলা প্রত্যাহার ও ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। মাসদাইর পুলিশ লাইন এলাকার একটি ছোট গার্মেন্টস মালিক আর্থিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গার্মেন্টস এর শ্রমিকদের দুই মাসের বেতন বকেয়া পড়ে যায়। এই অবস্থায় মালিক ব্যাংকের সাহায্য না পেয়ে শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করেই ফ্যাক্টরীর উৎপাদন বন্ধ করে দেন। তবে কথা থাকে কয়েক কিস্তিতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করে দেয়া হবে। সে মোতাবেক প্রথমে নারী শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হয়। এই ফ্যাক্টরীতে সর্বমোট শ্রমিক সংখ্যা ৪৬ জন। মালিক জামালপুরের বাসিন্দা। ঘটনাটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর।

পুলিশ লাইনের স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিক মালিকের আর্থিক দুর্বলতাকে পুঁজি করতে শ্রমিক নেতাদের খবর দেয়। শ্রমিক নেতাদের কাছে স্থানীয় শ্রমিকরা বাড়তি রং লাগিয়ে মিথ্যা তথ্য দেয়। বলে যে, ৪০০ শ্রমিকের ৮ মাসের বেতন না দিয়ে মালিকপক্ষ গার্মেন্টস বন্ধ করে দিয়েছে। মেশিনপত্র বিক্রি করে পালিয়ে যাবে। শ্রমিক নেতারা নিজেরাই বিসিক থেকে বেকার শ্রমিক এনে পুলিশ লাইন এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে। ওই গার্মেন্টস মালিককে গ্রেপ্তারের দাবি জানায়। মালিকপক্ষ মেশিনপত্র বিক্রি করে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করছিল সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। এ নিয়ে অভিযোগটি বিকেএমইএ পর্যন্ত আসলে যথাযথ তদন্ত করে দেখা যায় মালিকপক্ষ কিছু বখাটে শ্রমিকের ষড়যন্ত্রের শিকার। কিছু শ্রমিক ভেবেছিল মালিক যেহেতু জামালপুরের অতএব তাকে বাটে ফেলে মোটা অংকের চাঁদাবাজি করা যাবে। কিন্তু বিকেএমইএ’র নেতাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়।

গত ১৯ জানুয়ারি ফতুল্লার শাসনগাঁও এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুই পক্ষে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় মাদার কালার ও আরএস গার্মেন্টস নামের দুই কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের পর আশপাশের কয়েকটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। মাদার কালার গার্মেন্টস কারখানার অ্যাসিস্ট্যান্ট এডমিন ম্যানেজার শাহনেওয়াজ জানান, রিপন একজন শ্রমিক ৪ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। রোববার কাজে যোগ দেয়ার পরে কারখানার সুপারভাইজার মিজান তাকে ধমক দেন। এ নিয়ে তর্কের একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানাজানি হলে শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করে। পরে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদার কালার গার্মেন্টসের শ্রমিকরা আরএস গার্মেন্টসের শ্রমিকদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু আরএস গার্মেন্টসের শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ না দিলে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ।

পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত দেশের পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমই’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পোশাক খাতে অধিকাংশ শ্রমিকই নিরীহ। তারা কাজেই মগ্ন থাকে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হাতে গোনা কিছু শ্রমিক। এদের মধ্যে কিছু দুষ্কৃতকারী, কিছু এনজিওর লোক রয়েছে। তারা নিরীহ শ্রমিকদের অপকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দলের হয়ে শ্রমিকদের একটি পক্ষ পোশাক খাতকে অস্থিতিশীল করছে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতাকে সন্ত্রাসীরা মনে করছে- সেনাবাহিনী হোক আর পুলিশ হোক, গুলি তো করবে না। এ কারণে তারা ক্রিমিনাল কাজ করতে ভয় পাচ্ছে না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জে একটি কারখানার মালিক শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেননি। এ কারণে ওই কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা হামলায় চালিয়ে কারখানাটি ভাঙচুর করে। পাশের কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা ওই সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়।

বিকেএমইএ সভাপতি আরও বলেন, কিছু কারখানার মালিক সত্যি বিপদে আছেন। আবার ব্যাংকের কারণেও অনেকে সমস্যায় পড়েছেন। এটা অনেক শ্রমিক বুঝতে চান না। দেখা যায় মালিক বেতনের জন্য ব্যাংকে চেক দেন; কিন্তু ব্যাংকে নগদ টাকা না থাকায় শ্রমিকদের বেতন পেতে সমস্যা হচ্ছে। আগের সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা লুট হওয়ার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এদিকে, মালিকপক্ষকে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ভাতা সঠিকভাবে পরিশোধের আহ্বান জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, শ্রমিক ভাইবোনদের বকেয়া পাওনা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই মালিকদের কারখানা চলে। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। সব কারখানায় সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি ব্যত্যয়ের কোনো সুযোগ নেই। কেউ মজুরি বোর্ড বাস্তবায়ন না করলে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। মালিকপক্ষের সমস্যা পাওয়া গেলে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। শ্রমিক অসন্তোষ তৈরিতে বহিরাগতদের উসকানি রয়েছে কি-না, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি। শ্রমিক অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধান করা ও তা নিরসনে ক্লাস্টার ভিত্তিতে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত। তিনি বলেন, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভারসহ কারখানা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ক্লাস্টার ভিত্তিতে কমিটি গঠন করতে হবে। ওই কমিটি মালিকপক্ষকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে। তারা বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন কি-না, সেটিও নিশ্চিত করবে। শ্রমিক অসন্তোষ কেন হচ্ছে, তা অনুসন্ধান করে সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত