বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। প্রত্যেক ঋতুর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও শীত সবচেয়ে আলাদা। শীতের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি যেন বাংলাদেশের আসল রূপ। পৌষ-মাঘ মিলে শীতকাল হলেও শীতের আবহ তৈরি হয় একটু আগে থেকে। নিষ্প্রভ আকাশে অতিথি পাখির উপস্থিতি, কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত আর রাত-দিনের বিবর্তন যেন প্রকৃতিকে জানিয়ে দেয় শীতের আগমনী বার্তা। শীত প্রকৃতিতে যেমন বৈচিত্র্য আনে, তেমনি সুযোগ করে দেয় মোমিন ব্যক্তিকে পুণ্যের কাজে ব্রতী হওয়ার।
স্রষ্টার নিদর্শন উপলব্ধি : প্রকৃতিতে শীত আসে নিজ অস্তিত্বের দাপুটে জানান দিয়ে; যা গ্রীষ্ম ছাড়া অন্য কোনো ঋতুর ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায় না। সূর্যের নিস্তব্ধতা, উত্তরের ঝিরঝিরে বাতাস, দিগন্ত ছেয়ে যাওয়া সরষে ফুলের হলুদ গালিচা, রাতের সীমানা বিস্তৃত হ?ওয়া আর দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসা মানব মস্তিষ্কে অবচেতনভাবে তৈরি করে দেয় শীতের আবহ। প্রকৃতির এ অদৃশ্য বিবর্তন সৃষ্টিকে আকৃষ্ট করে সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী মহান স্রষ্টার দিকে। মোমিনের মানসপটে ভেসে ওঠে তখন কোরআনুল কারিমের হৃদয়স্পর্শী বাণী, ‘নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাতদিনের আবর্তনে বহু নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য; যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (এবং বলে) হে আমাদের রব! আপনি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র। সুতরাং আপনি আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)।
কল্যাণ সমৃদ্ধির উপায় : শীতকালে পৃথিবী যেন উন্মোচন করে দেয় তার ভেতরে জমিয়ে রাখা সকল রত্নভাণ্ডার। ফলে নতুন সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। বাগবাগিচা সমৃদ্ধ হয় ফল-ফুলে। মাঠ-ঘাট ছেয়ে যায় শাক-সবজি আর শস্য-ফসলে। শীতকাল যে শুধু প্রকৃতিকেই রাঙিয়ে তোলে, এমন নয়; বরং মানুষের হৃদয়েও এক নতুন সৃষ্টির জন্ম দেয়। তাই শীতকালে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পালিত হয় বহু আনন্দ-উৎসব। গাছিরা সংগ্রহ করে খেজুর রস। তা দিয়ে তৈরি হয় নানা স্বাদের পিঠাপুলি, পায়েস, সন্দেশ? ও হরেক রকম গুড়। শীতের সকালে কুয়াশা গায়ে মেখে কাঁচা রস পান করার যে অনুভূতি, তা আসলে বর্ণনা করে বুঝানো সম্ভব নয়। খেজুর রস শুধু প্রাকৃতিক মিষ্ট পানীয় নয়, বরং এ যেন আবহমান কাল থেকে চলে আসা গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক। শীতকালীন এ মিষ্ট পানীয়, শস্য-ফসল ও ফল-ফলাদি এ দেশ ও জাতির জন্য আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহের প্রকাশ। তাই সকলের উচিত, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা শোকরিয়া আদায় কর, তবে অবশ্যই আমি তোমাদের (নেয়ামত) বাড়িয়ে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিশ্চয় আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)।
দণ্ড থেকে পরিত্রাণের সুযোগ : শীতকাল প্রকৃতিকে জানার এক অনন্য ঋতু। এটি একদিকে যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনই বহু চ্যালেঞ্জও। এমনই এক চ্যালেঞ্জ হলো এর শুষ্ক আবহাওয়া। শীতের শুষ্কতা মানুষের শরীর-মন, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং দৈনন্দিন জীবনেও নানা প্রভাব ফেলে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে ত্বক রুক্ষ হয়, ফাটতে শুরু করে। ঠোঁট, হাত এবং পায়ের চামড়াও শুষ্ক হয়ে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। আবার শীতকালে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে বাতাসের আর্দ্রতাও কমে যায়। আর্দ্রতার অভাবে বাতাস?ও শুষ্ক হয়ে ওঠে। শুষ্ক বাতাসের সঙ্গে রাস্তাঘাটের ধুলোবালি মিশে বায়ু দূষণ সৃষ্টি করে। ফলে শ্বাসকষ্ট, এলার্জি ও ঠান্ডাজনিত নানা সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রকৃতির এ নেতিবাচক পরিবর্তন মোমিন ব্যক্তিকে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জাহান্নামে বিভিন্নভাবে শাস্তি দেয়া হবে। উত্তপ্ত আগুনের শাস্তি যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে তীব্র শীতের শাস্তিও। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করল, হে রব! আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে। অতঃপর তিনি তাকে দুটি নিঃশ্বাসের অনুমতি দিলেন। একটি নিঃশ্বাস শীতে, আরেকটি নিঃশ্বাস গ্রীষ্মে।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা গরমের যে প্রচণ্ডতা অনুভব কর, তা জাহান্নামের উত্তপ্ততা থেকে। আর শীতের যে তীব্রতা অনুভব কর, তা জাহান্নামের শীতলতা থেকে।’ (বোখারি : ৩২৬০, মুসলিম : ১৮৫)।
ইবাদতের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ : রাত দীর্ঘায়িত হ?ওয়া শীতের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির তাপমাত্রা শীতকালে কমে যাওয়ায় সূর্যাস্তের পর দ্রুতই অন্ধকার হয়ে আসে। শীতকালীন দিনগুলো ক্ষুদ্রতর হয়। কারণ, পৃথিবী তার অক্ষের চারপাশে ঘোরার সময় সূর্য পৃথিবীর কিছু অংশে কম আলো পৌঁছায়। বিশেষত উত্তর গোলার্ধে এর প্রভাব বেশি পড়ে। এ সময়ে সূর্য হ্রস্বভাবে ওঠে এবং দ্রুত অস্ত যায়। ফলে রাতে তাপমাত্রা কমে যায়। রাত?ও দীর্ঘ হয়। একেই মোমিন মোক্ষম সুযোগ মনে করে রাতের ইবাদতে মগ্ন হয়। কারণ, সে জানে, রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ফজর পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা বান্দাকে ডাকতে থাকেন, ‘আছে কি কেউ এমন, যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কেউ আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে তা দেব। কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’ (বোখারি : ৬৩২১, মুসলিম : ৭৫৮)। এ কারণে প্রখ্যাত তাবেয়ি মিযাদ ইবনে ইয়াজিদ (রহ.) বলেছিলেন, ‘যদি উত্তপ্ত দুপুরের (রোজাজনিত) তৃষ্ণা, শীতের দীর্ঘ রাত এবং তাহাজ্জুদে কোরআন তেলাওয়াতের স্বাদ না থাকত, তাহলে আমি মৌমাছি হয়ে যেতে পরোয়া করতাম না।’ (আয-যুহদ ওয়ার রাকাইক : ২৭৮)।
সহজে সিয়াম সাধনা : শীতকাল ঠান্ডা আবহাওয়া আর স্বল্প দৈর্ঘ্য দিনের জন্য বিখ্যাত। শীতের দিন ছোট হওয়া যদিও প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে এটা মোমিন জীবনে এনে দেয় শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের অপার সুযোগ। মোমিন ব্যক্তি শীতের এ ছোট দিনকে রোজা রাখার মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে অর্জন করতে পারে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যাপন করতে পারে পরিশুদ্ধ জীবন। বিশিষ্ট সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) একদিন তার শিষ্যদের বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে সহজ গনিমত সম্পর্কে জানাব না?’ তারা বললেন, ‘অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘শীতকালে রোজা রাখা (সহজ গনিমত)।’ (সুনানে বায়হাকি : ৪/২৯৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ধৈর্যের মাস (রমজান) এবং প্রতি মাসে তিনদিন রোজা সারা বছর রোজার সমতুল্য।’ (সুনানে নাসায়ি : ২৪০৮)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমলসমূহ (আল্লাহর কাছে) পেশ করা হয়। সুতরাং আমি রোজাদার অবস্থায় আমার আমল পেশ হওয়ার কামনা করি।’ (তিরমিজি : ৭৪৭)।
মানবসেবায় আত্মনিয়োগ : বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীয় দেশ। শীতকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শীতের প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঘন কুয়াশা, তাপমাত্রার ব্যাপক পতন, শৈত্যপ্রবাহ, পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকা এবং শীতজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় দরিদ্র-অসহায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মোমিন ব্যক্তির সামনে তখন সুযোগ এসে যায় জান্নাতি পোশাক সংগ্রহের। কারণ, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় পোশাক দেয়, আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ পোশাক পরাবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬৮২)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো মোমিনের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করবেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)।
অধিক পুণ্য অর্জনে সহায়ক : শীতকালে অলসতা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়। তীব্র শীত, শৈত্যপ্রবাহ এবং সূর্যের আলো কম থাকা হয়তো নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল, বাইরের ঝিরঝিরে শীতল বাতাস জনজীবনকে যেন স্থবির করে তোলে। তবে এ সকল প্রতিকূলতা মোমিনের অন্তরকে বিচলিত করতে পারে না। কারণ, সে জানে প্রতিকূল অবস্থায় ইবাদতের বিশেষ ফজিলতের কথা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত; একদিন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয় সম্পর্কে জানাব না, যা দ্বারা আল্লাহতায়ালা তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন?’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘(তা হলো) কষ্ট সত্ত্বেও পূর্ণরূপে অজু করা, মসজিদের দিকে বেশি বেশি হাঁটা এবং এক নামাজ আদায়ের পর পরবর্তী নামাজের জন্য অপেক্ষায় থাকা। এটাই সীমান্ত পাহারা।’ (মুসলিম : ২৫১)। যদিও এ হাদিসটি শীতকালের জন্য নির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি, তবে শীতকালের জন্য হাদিসে বর্ণিত বিষয়গুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাছাড়া হাদিসে যেহেতু ‘কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে, তাই এ ক্ষেত্রে অবশ্যই শীতের কষ্টও অন্তর্ভুক্ত। কারণ, তীব্র শীতে অজু-গোসলের জন্য ঠান্ডা পানি স্পর্শ করা কষ্টকর।
লেখক : ইমাম ও খতিব, ফকুরহাটি মধ্যপাড়া জামে মসজিদ, ভাঙ্গা, ফরিদপুর