ঢাকা বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নির্বাচন ও ভোটের বিধান

আজিজুল হক
নির্বাচন ও ভোটের বিধান

নির্বাচন একটি আনুষ্ঠানিক গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া; যেখানে জনসাধারণ একজন ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তিকে সরকারি পদে অধিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নেয়। অর্থাৎ নির্বাচন হচ্ছে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের পদ্ধতি; যেখানে স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ভোটাধিকারপ্রাপ্ত সকল নাগরিক ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি বাছাই করে অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের কোনো পদে প্রার্থীদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচিত করার নামই নির্বাচন। যারা ভোট দেয়, তাদেরকে নির্বাচক বা ভোটার বলে। ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি- ১. সাক্ষ্যপ্রদান, ২. সুপারিশ, ৩. প্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রদান। তাই কাউকে ভোট দেওয়া মানে তাকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তৈরি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিনিধিত্বের সনদ দেওয়া, লোকটি ভালো বলে সুপারিশ করা এবং লোকটি যোগ্য বলে সাক্ষ্য দেওয়া। সুতরাং ভোট খুবই গুরত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো মন্দ মানুষকে ভোট দিলে সেই মন্দের গোনাহ ভোটদাতার ভাগেও আসবে। আবার ভালো মানুষকে ভোট দিলে ভালো কাজের সওয়াবের ভাগিদার হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ভালো সুপারিশ করবে, সে তার নেকির ভাগি হবে; আর যে মন্দ সুপারিশ করবে, সে মন্দের অংশ পাবে।’ (সুরা নিসা : ৮৫)।

ইসলামে নির্বাচন পদ্ধতি : নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে ইসলাম সুনির্দিষ্ট কোনো পন্থা নির্ধারণ করেনি; বরং যুগ ও পরিবেশের প্রেক্ষিতে জনগণের জন্য যে পন্থা অধিক কার্যকর, কল্যাণকর এবং শরিয়তের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এমন পদ্ধতিই গ্রহণযোগ্য। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদার যুগে নির্বাচন পদ্ধতির কয়েকটি দিক দেখা যায়। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) সাধারণ মুসলিম জনতার রায়ে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন। আবার তার মৃত্যুশয্যায় বিশিষ্ট সাহাবিদের পরামর্শে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ওমর (রা.)-কে নির্বাচন করা হয়। তৃতীয় খলিফা ওসমান (রা.) পরামর্শ সভার মাধ্যমে নির্বাচিত হন। যেই পরামর্শ পর্ষদের প্রতি সবার আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। মোটকথা, ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, এমন কল্যাণকর যেকোনো পন্থা ইসলাম সমর্থন করে। (সমকালীন বিশ্ব : ৩১২)।

নির্বাচনে যা করা নিষিদ্ধ : মিথ্যা বলা, পরনিন্দা ও দোষচর্চা করা, অপবাদ দেওয়া, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বির ভালো কাজ স্বীকার না করা, গালাগালি করা, নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া, নেতার অন্ধ অনুসরণ করা, নিজের অবাস্তব প্রচারণা করা, ভোট কেনাবেচা করা, ইসলামি আদর্শ বিসর্জন দেওয়া, আতংক সৃষ্টি করা, ঝগড়াঝাটি ও মারামারি করা, অপরের সম্মানহানি করা, প্রচারে বাঁধা দেওয়া ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেউ অন্যের ক্ষতি করলে আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন। কেউ অযৌক্তিকভাবে কারো বিরোধিতা করলে, আল্লাহ তার বিরোধী হবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৬৩৫)।

ভোট দেওয়া জরুরি : বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট হয়। যেখানে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ আধিপত্যকামী, পুঁজিপতি, গডফাদার, মাফিয়া ও ক্ষমতালোভী। এসব রাজনৈতিক নেতা প্রতারণা করতে সিদ্ধহস্ত। অথচ ইসলামে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, খোদাদ্রোহী, রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচারকারীদের ক্ষমতায় বসার সুযোগ নেই। যদিও গণতন্ত্র ইসলামসম্মত নয়। কেননা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কখনোই পরিপূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। তবু অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য তুলনামূলক কম ক্ষতি বেছে নিতে হবে। মন্দের ভালো যে, তাকে ভোট দেওয়া চাই। গণতন্ত্র ও নির্বাচন পদ্ধতির যতই ত্রুটি থাকুক না কেন, বিবেক বিবেচনায় তুলনামূলক যে ভালো, তাকে ভোট দিতে হবে। হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। কারণ, ভোট না দেওয়ার ফলে যদি ইসলামবিরোধী বা কট্টর ইসলামবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসে আর ইসলামের বেশি ক্ষতি করে, তবে হাত গুটিয়ে থাকা ব্যক্তি মারাত্মক গোনাহগার হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি লোকেরা জালেম ব্যক্তিকে দেখেও তাকে বাঁধা না দেয়, তাহলে আল্লাহ তাদের সবাইকে শাস্তি দিতে পারেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫৩)। সেজন্য ভোটের মাধ্যমে ভালো ব্যক্তি বা মন্দের ভালোকে নির্বাচিত করে ইসলামবিদ্বেষী শক্তিকে রুখে দেওয়া ঈমানি দায়িত্ব।

ভোটের প্রচারণা : যে ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া জায়েজ, তার পক্ষে প্রচারণা করাও বৈধ। পক্ষান্তরে যাকে ভোট দেওয়া জায়েজ নয়, তার পক্ষে ভোটের প্রচারণা করাও জায়েজ নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও পরহেজগারিতে একে অপরের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যকে সাহায্য করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা মায়িদা : ২)।

ভোট গুরুত্বপূর্ণ আমানত : আমানত একটি বিস্তৃত আত্মিক ও নৈতিক দায়িত্ব; যা আল্লাহতায়ালা মানুষের ওপর অর্পণ করেছেন। পুরো জাতির পক্ষ থেকে সঠিক ও যোগ্য স্থানে ভোট প্রয়োগ একটি সংরক্ষিত আমানত। ভোট অযোগ্য ও ইসলামবিদ্বেষী ব্যক্তিকে দেওয়া মানে আমানতের খেয়ানত করা। আর আমানতের খেয়ানত করা কবিরা গোনাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ আমানতকে তার সঠিক হকদারের কাছে পৌঁছে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুরা নিসা : ৮৫)। আমানত রক্ষা করা ঈমানের অংশ এবং এর খেয়ানত করা মোনাফেকের লক্ষণ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত