ঢাকা শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনাল

ভারতের দ্বিতীয় না নিউজিল্যান্ডের প্রথম

ভারতের দ্বিতীয় না নিউজিল্যান্ডের প্রথম

প্রায় পঁচিশ’ বছর আগের স্মৃতি ফিরে এসেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির নবম আসরের ফাইনালে। ২০০০ সালের ১৫ অক্টোবর কেনিয়ার নাইরোবিতে জিমখানায় আইসিসির এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও নিউজিল্যান্ড। সেবার শেষ হাসি হেসছিল ব্ল্যাক ক্যাপসধারীরাই। তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির দারুণ এক সেঞ্চুরিও মেন ইন ব্লুদের জয় এনে দিতে পারেনি। ভারতকে ৪ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে কিউইরা। দুই যুগ পর আবারও সেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ভারত ও নিউজিল্যান্ড। আজ দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ট্রফি ঘরে তুলতে মাঠে নামবে দুই দল।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয়ে নিউজিল্যান্ডের স্মৃতি সুখের। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির নাম তখনও আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপ। ২০০০ সালে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় আসরে যখন শিরোপা জয় করে নিউজিল্যান্ড, উইল ইয়াংয়ের বয়স তখন আট। ক্রিকেটের প্রেমে সবে পড়তে শুরু করেছেন। বৈশ্বিক আসরে নিউজিল্যান্ডের প্রথম ট্রফি তার চোখে এঁকে দিয়েছিল স্বপ্ন। এখন সেই স্বপ্ন পূরণ করা থেকে স্রেফ একটি জয়ের দূরত্ব। ২৫ বছর আগের সেই দিনটি দেশের ক্রিকেটে আবার ফিরিয়ে আনতে চান ইয়াং। নাইরোবিতে ২০০০ সালের আসরের ফাইনালে অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির সেঞ্চুরিতে ভারত করেছিল ২৬৪ রান। সেই রান তাড়ায় এক পর্যায়ে নিউ জিল্যান্ডের রান ছিল ৫ উইকেটে ১৩২। কিন্তু ক্রিস কেয়ার্নসের দারুণ অপরাজিত সেঞ্চুরি ও ক্রিস হ্যারিসের সঙ্গে ১২২ রানের জুটিতে ম্যাচ জিতে নয় কিউইরা। সেই সময়ের সেরা অধিনায়কদের একজন স্টিভেন ফ্লেমিং উঁচিয়ে ধরেন ট্রফি। সেটিই প্রথম এবং শেষ। এরপর ২০০৯ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে নিউজিল্যান্ড। প্রতিবারই ট্রফির মঞ্চ থেকে ফিরতে হয়েছে ব্যর্থ হয়ে। প্রথম আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অবশ্য তারা জিতেছে ২০২১ সালে। তবে রঙিন পোশাকে বর্ণিল ফাইনাল আর আসেনি। ট্রফি সেই একটিই। দুই যুগেরও বেশি সময় পর আরেকটি ফাইনালের আগে ইয়াং ফিরে গেলেন তার সেই ছেলেবেলার স্মৃতিতে। ‘ওই স্কোয়াডে আইকনিক কিছু ক্রিকেটার ছিলেন এবং এখনকার দলের অনেকেই ওই ক্রিকেটারদের আদর্শ মেনেই বেড়ে উঠেছে। ২৫ বছর পর সেই কীর্তির পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ পাওয়াটা দারুণ। আমার বয়স তখন ছিল আট বছর, সবে খেলাটির ভালোবাসায় পড়তে শুরু করেছিলাম। ওই টুর্নামেন্টে নিউ জিল্যান্ড যেভাবে রাজত্ব করেছিল, তা ভালোভাবেই মনে আছে। তাদেরকে জিততে দেখাটা ছিল দারুণ ব্যাপার।’ এবার নিজেরাও সেই প্রাপ্তির আনন্দে ডুব দিতে চান। শুধু সেই স্মৃতির রোমন্থন নয়, নিজেরাও দেশক উপহার দিতে চান সেই সোনালি সাফল্য। ‘দেশ ছাড়ার সময় প্লেনে ওঠার আগে ওই সময়টার কথা ভাবছিলাম আমি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির স্কোয়াড ঘোষণার দিন স্কট স্টাইরাস (সেবারের জয়ী দলের অলরাউন্ডার) ছিলেন। ওই দলের এবং টুর্নামেন্টে তাদের পারফরম্যান্সের কিছু গল্প শুনেয়েছিলেন তিনি। অতীতকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারটি ভালো। নিউজিল্যান্ড আগেও কাজটা করেছে (চ্যাম্পিয়ন হয়েছে)। এখন ব্যাপারটা হলো সেই ধারা ধরে রাখার। আশা করি, দিন দুয়েকের মধ্যে আমরাও কাজটি করতে পারব।’

ভারতের সঙ্গে গত ছয় বছরে দারুণ কিছু লড়াই তাদের হয়েছে বড় মঞ্চে। ২০১৯ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে ভারতকে হারিয়েই তারা উঠেছিল ফাইনালে, ২০২১ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি জিতেছিল ভারতীয়দের হারিয়েই। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে আবার কিউইদের রান জোয়ারে ভাসিয়েছিল ভারত। ইয়াংয়ের মতে, আগের ম্যাচগুলোর কোনো প্রভাব নতুন লড়াইয়ে থাকবে না। ‘টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ও ২০২৩ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালসহ সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিপক্ষে বেশ কিছু দারুণ লড়াই আমাদের হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে জমজমাট কিছু ম্যাচ খেলেছি আমরা। তবে সত্য বলতে, সেসবের মূল্য এখানে কমই আছে। নির্দিষ্ট দিনে জ্বলে ওঠার ব্যাপার এখানে, অতীতে পড়ে থাকার সুযোগ নেই। আমরা চেষ্টা করব মানিয়ে নিতে এবং রোববার আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ যেটাই আসুক, আশা করি আমরা নিজেতের খেলা মেলে ধরব ও স্নায়ুর চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব।

এদিকে ভারত থেকে লাখো সমর্থকের চোখ থাকবে একটাই স্বপ্নপূরণের অপেক্ষায় আরেকটি আইসিসি ট্রফি ঘরে তোলার জন্য। রোহিত শর্মার নেতৃত্বে দাপুটে এক অভিযানের পর সামনে এখন শেষ বাঁধা। এই মহারণে জিততে হলে এগিয়ে আসতে হবে কিছু নির্দিষ্ট ক্রিকেটারকে, যারা একা হাতে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। ভারতের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে পাঁচ খেলোয়াড়। তারা হলেন- বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ার, হার্দিক পান্ডিয়া, বরুণ চক্রবর্তী ও রবীন্দ্র জাদেজা। এই পাঁচজনের পারফরম্যান্সই ঠিক করে দিতে পারে, চ্যাম্পিয়নদের মঞ্চে ট্রফিটা কার হাতে উঠবে।

ভারতের বড় ম্যাচ মানেই বিরাট কোহলি। চার ম্যাচে ২১৭ রান করে ফাইনালের আগে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার। এক সেঞ্চুরি, এক ফিফটি। প্রতিটি ইনিংসেই তার দৃঢ়তা চোখে পড়েছে। কোহলির ব্যাটিং মানেই ক্লাস, মানেই শুদ্ধতা। স্পিনারদের বিপক্ষে তার পায়ের কাজ দুর্দান্ত, পেসারদের বিরুদ্ধে টাইমিং অনন্য। সবচেয়ে বড় ব্যাপার তিনি জানেন কীভাবে ম্যাচ জিততে হয়। আগের ফাইনালগুলোর হতাশা ঝেড়ে ফেলে এবার কি কোহলি এনে দেবেন সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত? ভারতের মিডল অর্ডারে এখন নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন শ্রেয়াস আইয়ার। ধারাবাহিকভাবে রান করছেন, পরিস্থিতি বুঝে খেলছেন, আর বিপদের সময়ও স্বাভাবিক ব্যাটিং করতে পারেন। তিন নম্বরে এসে কিংবা চার নম্বরে নেমেও ম্যাচের গতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন তিনি। এই টুর্নামেন্টেও বেশ ভালো ফর্মে আছেন আইয়ার। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার ব্যাট থেকে আসা এক ঝকঝকে ইনিংসই হয়তো গড়ে দেবে ভারতের শিরোপার ভিত। ভারতের জয়ের অন্যতম চাবিকাঠি যদি কেউ হন, তবে সেটা হার্দিক পান্ডিয়া। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন ডিপার্টমেন্টেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সামর্থ্য আছে তার। এই টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে বড় ইনিংস না পেলেও দ্রুত রান তোলার কাজে দুর্দান্ত ছিলেন। ফাইনালের মঞ্চে তার অলরাউন্ড পারফরম্যান্সটাই হতে পারে পার্থক্য গড়ে দেয়া ফ্যাক্টর। ম্যাচ যদি শেষ ওভারে যায়, ভারত চায় ম্যাচ জেতানো একজন হার্দিক পান্ডিয়াকে। এই এক নামই হয়তো ফাইনালের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। বরুণ চক্রবর্তীর বোলিংয়ের রহস্য এখনো অনেক ব্যাটারের কাছেই অজানা। তার ভ্যারিয়েশন, স্লোয়ার ডেলিভারি, লেংথ মেশানো বোলিং সবকিছুই হতে পারে প্রতিপক্ষের দুঃস্বপ্ন। ভারত বরাবরই আইসিসির নকআউটে স্পিনারদের ওপর নির্ভর করেছে। এই ম্যাচেও বরুণ সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফাইনালে ব্যাটাররা যখন চাপে থাকবে, তখন বরুণের একটা স্পেলই খেলার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। টুর্নামেন্ট জুড়ে বল হাতে কার্যকর ছিলেন, নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছেন। এই ফাইনালেও ভারতের জয় নির্ভর করবে তার অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের ওপর। বিপক্ষ যখনই ম্যাচ থেকে ছিটকে দিতে চাইবে ভারতকে, তখনই হয়তো জাদেজা ছোবল মেরে দেবে। ফাইনালে জিততে হলে শুধু ব্যাটিং-বোলিং নয়, দরকার ফিল্ডিংয়ে অতিরিক্ত স্পার্ক। আর সেটার নাম রবীন্দ্র জাদেজা! ব্যাট হাতে ঝড় তুলতে পারেন, বল হাতে উইকেট আনতে পারেন, আর ফিল্ডিংয়ে তো তিনি জীবন্ত ম্যাজিক! নিউজিল্যান্ডের পাঁচ তুরুপের তাসের বিপরীতে ভারতের এই পাঁচ তাস যদি নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারে, তাহলে ট্রফি উঠতে পারে রোহিত শর্মার হাতে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত