গত বছরের জুলাই আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তে দায়িত্ব নিয়েছে অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকার। তারপর থেকে দেশের প্রায় সব সেক্টরে পরিবর্তন এসেছে। তারমধ্যে অন্যতম ছিল ক্রীড়াঙ্গণ। প্রথমেই বদল আসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি)। সংস্থাটির সভাপতিসহ কয়েকজন পরিচালক বদল হয়। নতুন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক ক্রিকেটার ফারুক আহমেদ। কিন্তু দশ মাস পেরুতে না পেরুতেই আবারও শীর্ষ পদে পরিবর্তনের গুঞ্জন উঠেছে। গত বুধবার রাাতে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার ধানমন্ডির বাসায় সাক্ষাৎ করেছেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। ওই বৈঠকে ক্রীড়া উপদেষ্টা নাকি তাকে জানিয়ে দেন সরকার চায় আপনি বিসিবির নেতৃত্বে থাকুন। তবে এটি মানতে নারাজ বিসিবি প্রধান। এ নিয়ে হঠাৎ উত্তাল বিসিবি।
জানা গেছে সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল আবার আগ্রহ জানিয়ে রেখেছেন বিসিবি সভাপতি হওয়ার। ফারুক পদত্যাগ করলে আমিনুল যদি সভাপতি হন তাহলে সরকারি হস্তক্ষেপের জন্য আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে বিসিবি। এমন পরিস্থিতিতে ফারুক আহমেদ নিশ্চিত করেছেন পদত্যাগ না করার কথা। বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ‘ক্রীড়া উপদেষ্টা সাহেব আমাকে বলেছেন, বিসিবি প্রধান পদ থেকে সরে দাঁড়াতে। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পদত্যাগ করব না। আমাকে বলা হয়েছে, সরকার নাকি আমাকে আর বিসিবি সভাপতি হিসেবে রাখতে চাইছে না। কেন রাখতে চাইছে না, সেটার কোনো কারণ তারা আমাকে বলেনি। বিনা কারণে তো আমি পদত্যাগ করতে পারি না।’ ক্রীড়া উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে বললে জবাবে কি আপনি কিছু বলেছেন? ফারুক বললেন, ‘আমি ক্রীড়া উপদেষ্টাকে বলেছি, আমি তো আর নিজে যেচে বিসিবি প্রধানের চেয়ারে বসিনি। জানতে চেয়েছি, আমি কি আপনাকে ফোন করে বিসিবি সভাপতি হতে চেয়েছিলাম? তিনি বলেছেন না। তাহলে এখন আমাকে সরিয়ে দেয়া কথা উঠছে কেন?’
বিপিএল আয়োজনে এবার পুরোপুরি সফল ছিল না বিসিবি। সেই দায়টা ফারুক আহমেদের উপরই বর্তায়। তবে তার হাত ধরেই বিপিএল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ হয়েছে এবার। তাই সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে ক্রীড়া উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন ফারুক, ‘কালকে তো কথা হলো, আমি এখনো চিন্তা করছি। কিছু সময় প্রয়োজন। আমি কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না, ঠিক কী কারণে পদত্যাগ করব। তাৎক্ষণিকভাবে কোনোই সিদ্ধান্ত দেইনি। ক্রীড়া উপদেষ্টাকে বলেছি, আমি আমার পরিবার, সুহৃদণ্ডশুভানুধ্যায়ীদের সাথে কথা বলে জানাবো।’
ফারুক আহমেদের ‘ভাবনা’ মানে পদত্যাগ করা। নিয়ম মানলে আপাতত এটা ছাড়া বোর্ড সভাপতি বদলের কোনো সুযোগ নেই। কারণ বোর্ড পরিচালক হয়ে এরপর অন্য পরিচালকদের ভোটে গঠনতন্ত্র মেনেই সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। সরকার বা সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ তাকে সরিয়ে দেয়ার এখতিয়ার রাখে না। বরং সরকারের হস্তক্ষেপের প্রমাণ পেলে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসতে পারে বাংলাদেশের ওপর। অতীতে শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের ক্ষেত্রে এমন নজির আছে। ফারুক নিজে থেকে পদত্যাগ না করলে তাই মন্ত্রণালয়ের কিছু করার সুযোগ সামান্যই।
এই মুহূর্তে অবশ্য বড় প্রশ্ন পরিবর্তন চাওয়ার পেছনের কারণ নিয়ে। প্রধান নির্বাচক হিসেবে দুই দফায় বিসিবির অধীনে চাকরি করেছেন ফারুক। ২০১৬ সালে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর বোর্ডের ধারেকাছে ছিলেন না তিনি। ব্যস্ত ছিলেন মূলত ব্যবসা নিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফারুকের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনয়নে সরাসরি পরিচালক করে তাকে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ৯ মাস পরই কেন চিত্র এতটা বদলে গেল, এটা নিয়েই এখন কৌতূহল। ফারুকের বিরুদ্ধে অবশ্য আর্থিক অনিয়মসহ কিছু অভিযোগ উঠেছে গত কিছুদিনে। গত বিপিএলে নানা অব্যবস্থাপনা নিয়েও তুমুল বিতর্কের মধ্যে পড়তে হয়েছিল তাকে। সেসময়ও একবার গুঞ্জন উঠেছিল, কোনো প্রক্রিয়ায় তাকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। তবে বিপিএলে এবার মাঠে প্রচুর দর্শক উপস্থিতি ও টিকেট বিক্রির আয়ে রেকর্ড গড়েও প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।
আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিসিবি নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা আছে। কয়েক মাস ধরেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতিসহ সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন ফারুক। এর মধ্যেই তার জন্য ধাক্কা হয়ে এলো উপদেষ্টার চাওয়া। পদত্যাগ না করলে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে তিনি দায়িত্ব কতটা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারবেন, সেটিও এখন প্রশ্ন। শনিবার বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের একটি পূর্ব নির্ধারিত সভা আছে। এখন তা রূপ নিয়েছে মহাগুরুত্বপূর্ণ এক সভায়। ফারুক যদিও তেমন কিছু বলতে চাইলেন না সভা নিয়ে, “এই সভায় আলোচনার অনেক বিষয়ই আছে। আমার ব্যাপারটি এখানে মুখ্য নয়।”
শেষ পর্যন্ত ফারুক আহমেদ পদত্যাগ করলে তার জায়গায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনয়েন পরিচালক হবেন আরেক সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তাকে পরিচালক হওয়ার প্রস্তাব বেশ কদিন আগেই দেওয়া হয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। পরিচালক হওয়া মানে যে বোর্ড সভাপতি হওয়ার দিকেও এগিয়ে যাওয়া, সেটিও পরিষ্কার। যদিও আমিনুল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি দায়িত্ব নিলে সেটি স্রেফ আগামী বিসিবি নির্বাচন পর্যন্তই হবে। দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব নেয়া বা বিসিবি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছে তার নেই।