
ক্রিকেটকে নিয়ে প্রথম কথাটিই বলা হয়, গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। সেরা ব্যাটার আউট হয়ে যেতে পারেন শূন্য রানে। আবার সেরা বোলারটির ভাগ্যে কখনও কোনো উইকেটই জোটে না। দিনের সেরা বোলার শেষ বলে চার-ছক্কা হজম করে মাঠ ছাড়েন হারের লজ্জা নিয়ে। এমনটা তো ক্রিকেটে প্রায়শই ঘটে থাকে। এ কারণেই সম্ভাবত ক্রিকেটের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই মানিয়ে যায় ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তা’ কথাটি। স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যেকার সিরিজের পঞ্চম ও শেষ টেস্ট যেন সেটিই করে দেখাল।
ওভালে চতুর্থ দিনেই শেষ হতে পারত খেলা। হ্যারি ব্রুক ও জো রুটের সেঞ্চুরিতে জয়ের পথে ছিল ইংল্যান্ড। তবে শেষ বিকালে আচমকা তিন উইকেটের পতনে ম্যাচ আসে নতুন মোড়। শেষ দিনে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ৩৫ রান, আর ভারতের দরকার ৪ উইকেট। এমন সমীকরণ সামনে রেখে পঞ্চম ও শেষ দিনে মাঠে নামে দুই দল। রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন দর্শকরা। ঠিক সে সময় দৃশ্যপটে হাজির হন মোহাম্মদ সিরাজ! যার ব্যাটে বল লেগেও স্টাম্প ভাঙায় এই সিরিজে একটা টেস্ট হেরেছিল ভারত। সেই সিরাজই গাস অ্যাটকিনসনের স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে ভারতকে নাটকীয় জয় এনে দিলেন। খলনায়ক হতে হতেও সিরাজ নায়ক হলেন ৫ উইকেট নিয়ে, ভারতকে ৬ রানে জিতিয়ে, অ্যান্ডারসন-টেন্ডুলকার সিরিজ ড্র করে। ২-২ সমতায় শেষ হল মহানাটকীয় ৪৬ দিনের এক সিরিজ। সিরিজটাই ছিল রোলার কোস্টারের মতো। কখনও দাপট দেখিয়েছে ইংল্যান্ড তো কখনও ভারত। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা সিরিজের শেষ দিনে আবার বড় ভূমিকা রাখল ভারী রোলার। খেলা শুরুর আগে হেভি রোলারের ব্যবহার করে ভোরের শিশির বা আর্দ্রতা কমিয়ে ফেলেছিল ইংল্যান্ড। পেসারদের সুইং আর স্পিনারদের টার্ন কমে যায় তাতে।
এর মাঝেই ‘যোদ্ধা’ সিরাজ আগুন ঝরালেন ঠিকই। কঠিন হয়ে পড়া সমীকরণটা মেলাতে উজার করে দিলেন নিজেকে। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিলেন আরেক পেসার প্রসিধ কৃষ্ণা। তাতেই রোমাঞ্চকর জয় পেল ভারত। ইংল্যান্ডকে আজ ৩৬৭ রানে অলআউট করে দিল তারা। গতকাল সোমবার ইংল্যান্ডের শেষ ৪ উইকেটের ৩টিই নিয়েছেন সিরাজ। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা গাস অ্যাটকিনসনকে বোল্ড করে সিরাজই নিশ্চিত করেন রুদ্ধশ্বাস জয়। সবমিলিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৫ রানে ৫ উইকেট নিয়েছেন সিরাজ। প্রসিধ কৃষ্ণা নেন ৪ উইকেট। আগের দিন হ্যারি ব্রুকের ক্যাচ হাতে জমিয়েও ছক্কা বানিয়ে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন সিরাজ। সেই সিরাজই খলনায়কের বদলে নায়ক হলেন ভারতের। এজন্যই ভারতীয় দল যখন মাঠ প্রদক্ষিণ করে সমর্থকদের অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছিল তখন সিরাজকে ঘিরে ছিল বাড়তি উচ্ছ্বাস। শেষ দিনে জয়ের জন্য কেবল ৩৫ রানই লাগত স্বাগতিকদের আর ভারতের দরকার ছিল ৪ উইকেট। নিজের প্রথম ওভারেই সিরাজ উইকেটের পেছনে ধ্রুব জুরেলের ক্যাচ বানিয়ে ফেরান আগের দিনের অপরাজিত ব্যাটার জেমি স্মিথকে (২ রান)। এক ওভার পর আবারও সিরাজের জাদু। অপরাজিত আরেক ব্যাটার জেমি ওভারটনকে (রান) করেন এলবিডব্লিউ। বেশিক্ষণ টিকতে পারেনেনি জশ টাংও। ১২ বল খেলে কোনো রান না করা টংকে বোল্ড করেন প্রসিধ কৃষ্ণা। সাহসী ক্রিস ওকস ভাঙা হাত নিয়ে ক্রিজ না নামলে ম্যাচটা শেষ হয়ে যেতে পারত তখনই। কিন্তু জীবন বাজি রেখে নেমে পড়লেন তিনিও। চতুর্থ দিন শেষেই জো রুট বলেছিলেন, ‘এটা এমন এক সিরিজ, যেখানে খেলোয়াড়দের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলতে হয়েছে। ঋষভ পন্ত ভাঙা পা নিয়েই ব্যাট করেছেন (ম্যানচেস্টারে)। ক্রিস ওকসও ইংল্যান্ডের জন্য নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে প্রস্তুত।’ সেই ওকস মাঠে নামার সময় করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান দর্শকরা। ওকস নামার সময় জয়ের জন্য ১৭ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের। গাস অ্যাটকিনসন মোহাম্মদ সিরাজকে ছক্কা মেরে লক্ষ্য কমিয়ে আনেন ১১-তে। ওকসের কারণেই সিঙ্গেল নেওয়ার উপায় ছিল না। পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ব্যাট করছিলেন তিনি। ৯ নম্বরে নামলেও এর আগে টেস্টে একটি সেঞ্চুরি করেছিলেন অ্যাটকিনসন। কাজে লাগাচ্ছিলেন সেই অভিজ্ঞতা। ৮৪তম ওভারের শেষ বলটা ব্যাটে লাগাতে পারেননি অ্যাটকিনসন। বল উইকেটকিপারের হাতে দেখেও রানের জন্য দৌড়ান অ্যাটকিনসন ও ওকস। সহজ রান আউট সুযোগটা মিস করে বসেন জুরেল! সিরাজের চোখে মুখে তখন হতাশার ছাপ। কৃষ্ণার করা পরের ওভারের প্রথম বলেই অ্যাটকিনসন নেন ২ রান। ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য দরকার তখন ৮ রান। কিন্তু সেই অঙ্কটা মেলাতে পারেনি স্বাগতিকরা। ‘বাজবল’ খেলে হেডিংলিতে ৩৭১ রান তাড়া করে ভারতকে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। ওভালে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডটা ছিল ২৬৩ রানের। সেই রেকর্ডটাও হয়েছে ১২৩ বছর আগে ১৯০২ সালে।