
সাইলেন্ট কিলার-ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এই নামটাই যথেষ্ট মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বোঝাতে। জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন, দেশের হয়ে আর তাকে দেখা যাবে না লাল-সবুজের জার্সিতে। তবু যেন ক্রিকেট তার হৃদয়ে এখনও গেঁথে আছে রক্তধারার মতো। ৪০ ছুঁইছুঁই বয়সে যেখানে অধিকাংশ ক্রিকেটার বিশ্রাম খোঁজেন, ক্যারিয়ার শেষের প্রহরে মন দেন অন্য ব্যস্ততায়, সেখানে রিয়াদ এখনও অনুশীলন করছেন পরিপূর্ণ নিবেদন নিয়ে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হবে এনসিএল টি-টোয়েন্টি। হাতে প্রায় দেড় মাস সময়। কিন্তু রিয়াদ এরমধ্যেই অনুশীলনে নেমে পড়েছেন। এতো আগেভাগে প্রস্তুতি শুরু করার মানে একটাই-ক্রিকেটকে এখনও তিনি নিজের অস্তিত্বের অংশ মনে করেন। জাতীয় দলে প্রমাণ করার আর কিছু নেই, আর তেমন কোনো চ্যালেঞ্জও নেই সামনে। কিন্তু তবু তার এই নিঃশব্দ যুদ্ধ, যেন নিজেকে নয়, ক্রিকেটকে সম্মান জানানোর এক নিঃশব্দ অনুশীলন। রিয়াদের ক্যারিয়ার এমনই এক সমান্তরাল গল্পের নাম, যেখানে কখনও আকাশছোঁয়া উল্লাস, আবার কখনও গ্লানির দীর্ঘশ্বাস। বহুবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন ফর্ম নিয়ে, বাদ পড়েছেন দল থেকে। আবার সেখান থেকেই ফিরে এসে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় সব মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার সেঞ্চুরি-যেখানে বাংলাদেশ প্রায় হেরে বসেছিল, সেই ম্যাচটিকে জয়ের গল্পে রূপ দেন রিয়াদণ্ডসাকিব। ঐ ইনিংস শুধু ম্যাচ জেতায়নি, বরং প্রমাণ করেছে, চাপের মুহূর্তে কারা সত্যিকারের ম্যাচ উইনার।
এর ঠিক পরের বছর নিদাহাস ট্রফি। শ্রীলঙ্কার মাটিতে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, এক চরম নাটকীয় ম্যাচে রিয়াদ যখন শেষ ওভারে ছক্কা মেরে বাংলাদেশকে ফাইনালে তোলেন-সেই মুহূর্তটা শুধুই একটি শট ছিল না, ছিল হাজারো সমালোচনার জবাব, ছিল এক নির্ভরযোগ্য মধ্যমণির পুনর্জন্ম। তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও কম দেখেননি রিয়াদ। যেমন ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি, যেখানে জয় মানেই সেমিফাইনাল।
কিন্তু সেদিন ব্যাট হাতে যেন নিজেকে খুঁজে পাননি রিয়াদ। একের পর এক ডট বল খেলে হয়ে উঠেছিলেন সমালোচনার কেন্দ্র। ক্রিকেটার হিসেবে এমন দিনও আসে- সেটিই হয়তো তার প্রমাণ হয়ে থাকে। এরপর ভারতের বিপক্ষে সিরিজে ছিলেন, কিন্তু সেটিই হয়ে দাঁড়ায় জাতীয় দলের জার্সিতে তার শেষ অধ্যায়। টেস্ট থেকে আগেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন, ওয়ানডের শেষটাও করেন, নিজের মতো করেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ম্যাচ দিয়েই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি রিয়াদ। জাতীয় দলের বাইরে থাকলেও তিনি যেন ক্রিকেটের শিকড়ের দিকে ফিরে গেছেন-ঘরোয়া ক্রিকেটে। তরুণদের ভিড়ে যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলা সহজ, সেখানে রিয়াদ ঠিকই নিয়মিত অনুশীলন করে যাচ্ছেন।
বয়সে তিনি প্রবীণ, কিন্তু মনোভাবে এখনও অনুপ্রেরণার তরুণ। এই নিবেদন, এই নিষ্ঠা, এই প্রেমই তাকে আলাদা করে দেয়। জাতীয় দলে তার আর কিছু প্রমাণ করার নেই, তবু যেন নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই ক্রিকেটারের কাছে দায়বদ্ধ তিনি-যে ছোটবেলায় প্রথম ব্যাট ধরেছিল। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে তাই শুধু রান, গ্লাভস, কিংবা ব্যাট দিয়ে মাপা যায় না- তাকে মাপতে হয় হৃদয় দিয়ে, যেখানে এখনও বাজে ক্রিকেটের জন্য একনিষ্ঠ ভালোবাসার স্পন্দন।