
গত মাসে মিয়ানমারে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে ঋতুপর্ণা চাকমারা। গতকাল রোববার আরেকটি বড় সাফল্য নিয়ে এসেছে মোসাম্মৎ সাগরিকাণ্ডতৃষ্ণা রানীদের নিয়ে গড়া বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবল দল। প্রথমবার নারী এশিয়ান কাপের টিকিট পেল লাল সবুজের তরুণীরা। যদিও গ্রুপের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ৬-১ গোলে হেরে পিটার বাটলারের দলের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারত। তবে সমীকরণের খেলায় জিতে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ দল।
চীনের কাছে লেবানন ৮-০ গোলে হেরে যাওয়ায় সেরা তিন রানার্সআপের একটি হয়ে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপে জায়গা করে নিয়েছে লাল সবুজ দল। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হারার পর এশিয়ান কাপের মূল পর্বে যাওয়ার অপেক্ষা বাড়ে বাংলাদেশের। তখন সমীকরণ দাঁড়ায়, ‘ই’ গ্রুপে থাকা লেবাননকে চীন হারালেই বাংলাদেশ চলে যাবে মূল পর্বে। শেষ পর্যন্ত চীনের সামনে পাত্তাই পায়নি লেবানন। লেবানন বড় ব্যবধানে হারায় নিশ্চিত হয়ে যায় আট রানার্সআপের পাঁচটিই থাকছে বাংলাদেশের নিচে।
এদিন দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের সমীকরণ ছিল ড্র করলেই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে নাম লেখাবে আফঈদা খন্দকাররা। এমন একটা সমীকরণ সামনে রেখে শক্তিশালী দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। ম্যাচের প্রথমার্ধে চোখে চোখ রেখেই লড়াই করে সাগরিকারা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন কোচ পিটার বাটলারের শিষ্যরা। ভিয়েনতিয়েনের নিউ লাওস ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে প্রথমার্ধে ১-১ সমতা ধরে রাখলেও দ্বিতীয়ার্ধে রীতিমতো ধরাশয়ী হয় বাংলাদেশ। গুনে গুনে আরও পাঁচ গোল হজম করে মেয়েরা। দক্ষিণ কোরিয়ার একচেটিয়া দাপটের মুখে লাল সবুজের মেয়েরা ৬-১ গোলে হেরেছে।
ম্যাচে কোরিয়া সবদিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের বিপক্ষে তেমন সুবিধা করতে পারছি না। বরং বাংলাদেশ প্রথম গোল করে তাদেরকে চমকে দেয়। দ্বিতীয় মিনিটেই দারুণ সুযোগ কড়া নেড়েছিল দুয়ারে। সতীর্থের লং পাস ধরে গোলকিপারকে একা পেয়েও গিয়েছিলেন সাগরিকা। কিন্তু বলের স্পর্শ জোরে হওয়ায় ঠিকঠাক শট নিতে পারেননি। ওই সময়ই সাগরিকা চিপ করতে পারলে গোল হতে পারতো। ১৪ মিনিটে তৃষ্ণা রানী বক্সের ঠিক ওপরে বল পেয়েছিলেন, কিন্তু দুই ডিফেন্ডারের বাধা পার হতে ব্যর্থ হন তিমুর লেস্তের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা এই ফরোয়ার্ড। পরের মিনিটেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। কারিগর সাগরিকা।
তার পাস বাঁ প্রান্তে পেয়ে শান্তি মার্ডি বক্সে ঢুকে গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা ডিফেন্ডারের বাধা এড়িয়ে আড়াআড়ি পাস বাড়ান। বল গোলকিপারের গ্লাভস ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর আলতো টোকায় জালে জড়িয়ে দেন তৃষ্ণা।
এর পরই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কোরিয়ার হাতে। পরিকল্পিত আক্রমণ থেকে দ্রুত সমতায় ফেরে তারা এবং ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে থাকে। বাংলাদেশের তিন ডিফেন্ডারের হাই-লাইন ডিফেন্স ভেদ করে লং বল থেকে গোল আদায় করে নেয় কোরিয়া। সেই ধারায় ১৯ মিনিটেই সমতায় ফেরে দক্ষিণ কোরিয়া। বাম দিক থেকে আসা আক্রমণ আটকাতে পোস্ট ছেড়ে কিছুটা এগিয়েছিলেন স্বর্ণা রানী মন্ডল। সতীর্থের পাস ধরে ফাঁকায় থাকা লি হেউন সহজেই খুঁজে নেন জাল। একটু পর কোরিয়ানদের শট আটকে বাংলাদেশের ত্রাতা হন স্বর্ণা। ২৪ মিনিটে শান্তিকে তুলে নেন পিটার বাটলার। ৪৪ মিনিটে শিখা সিনহার বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের জোরালো শট গোলকিপারের হাতে জমা পড়ে। তাতে ৪৫ মিনিট শেষে ১-১ স্কোরলাইন রেখে ড্রেসিংরুমে গেছে দুইদল। বিরতির পর বাংলাদেশকে অসহায় বানিয়ে কোরিয়ার একচেটিয়া দাপট দেখায়। ৫টি গোল আসে দ্বিতীয়ার্ধে।
অধিনায়ক চো হিয়ং একাই জোড়া গোল করে বাংলাদেশকে ব্যাকফুটে ফেলে দেন। ৪৭ ও ৬৭ মিনিটে গোল দুটি হয়। দুটি গোলই বক্সে ঢুকে গোলকিপারের পাশ দিয়ে জড়িয়ে যায় জালে। ৮৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে চতুর্থ গোল আসে। ৯০ মিনিটে হেডে পঞ্চম গোল করে কোরিয়া পুরোপুরি ছিটকে দেয় বাংলাদেশকে। যোগ করা সময়ে ষষ্ঠ ও শেষ গোল করে নিজেদের জাত চেনায় কোরিয়া। এতোদিন উড়তে থাকা পিটার বাটলারের দলকে মাটিতে নামিয়ে আনলো কোরিয়া। তিন ম্যাচে তিন জয় নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া উঠে যায় চূড়ান্ত পর্বে। তবে বাংলাদেশের সামনে আসে আরেক সমীকরণ। সেরা তিনটি রানার্সআপ দলের একটি হয়ে চূড়ান্ত পর্বে যাওয়ার সুযোগ। ‘সি’ গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া-চায়নিজ তাইপে, ‘ই’ গ্রুপে চীন-লেবানন ও ‘জি’ গ্রুপের উজবেকিস্তান-জর্ডান ম্যাচের ফলের ওপর ঝুলে পড়ে বাংলাদেশের ভাগ্য। তবে লেবানন চীনের কাছে হেরেই গেলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে বাংলাদেশের চূড়ান্ত পর্বে উত্তরণ। সমীকরণের খেলায় ভাগ্য সহায় হয় সাগরিকাদের।
লেবাননকে ৮-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছে চীন। তাতেই কপাল খুলেছে বাংলাদেশের। চীনের এই জয়ে নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের সেরা তিনে থাকা। ৩ ম্যাচ শেষে বাংলাদেরে পয়েন্ট ৬ আর গোল ব্যবধান +৫। চীনের কাছে হারায় লেবাননের পয়েন্ট ৬-এ আটকে থাকল। আর তাদের গোল ব্যবধান-৬। তাতে সেরা তিন রানার্সআপ হিসেবে মূল পর্বে খেলা নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের। অন্য গ্রুপের ফল যাই হোক, আট রানার্সআপের পাঁচটিই থাকবে বাংলাদেশের নিচে।
?এশিয়ার ৩৩টি দল নিয়ে বাছাইপর্ব চলছে আটটি গ্রুপে ভাগ হয়ে। প্রতি গ্রুপের সেরা দল আর সেরা তিন রানার্সআপ জায়গা করে নেবে আগামী বছর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মূল আসরে।
এশিয়ান কাপে ভালো করলে মিলবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী বিশ্বকাপের টিকিটও। থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ১২ দলের এশিয়ান কাপে সেমিফাইনালে যাওয়া চার দল পাবে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ। একই বছরের সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ডে হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী বিশ্বকাপের ১২তম আসর। বিশ্বকাপের বর্তমান চ্যাম্পিয়নও উত্তর কোরিয়া।