ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অবাধ্য সন্তানের পরিণতি

দিদার শফিক
অবাধ্য সন্তানের পরিণতি

মা-বাবা সন্তানের সবচেয়ে আপনজন। সন্তানের জন্য পৃথিবীতে মা-বাবার চেয়ে স্নেহশীল আর কেউ নেই। তারা সন্তানের জন্য নিজের আরাম আয়েশ থেকে শুরু করে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও সন্তানের মুখে একটু হাসি দেখতে চায়। এ ত্যাগ মা-বাবা ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মা-বাবা সন্তানের কাছে সবচেয়ে ভালো আচরণের হকদার। মা-বাবার সুখের জন্য ও আরামের জন্য সন্তানকেও ভাবতে হয়। দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এটা স্বাভাবিক দাবি, ধর্মেরও দাবি। মা-বাবা যেন সন্তানের আচরণে কষ্ট না পায়- এজন্য সন্তানকে সবসময় সতর্ক থাকা আবশ্যক। মা-বাবার অবাধ্যতা বা তাদের সঙ্গে অসদাচরণ নিষিদ্ধ। এটা চরম গোনাহের কাজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না, মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, মা-বাবার কোনো একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের উহ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না; বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩)।

অবাধ্য সন্তানের পরিণতি : মা-বাবার অবাধ্যতা কবিরা গোনাহ। এ প্রসঙ্গে নবী (সা.)-এর হাদিস আছে। নবী (সা.) তার সাহাবিদের উদ্দেশে একদিন তিনবার বললেন, ‘সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহগুলো সম্পর্কে আমি কি তোমাদের অবহিত করব না?’ সবাই বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, অবশ্যই বলুন।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া।’ (বোখারি) অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির প্রতি মহান আল্লাহ কেয়ামতের দিন রহমতের দৃষ্টি দেবেন না। এক. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান। দুই. পুরুষের বেশধারী নারী এবং তিন. দাইয়ুস (পরিবারকে নাফরমানির অনুমতি দাতা, পরিবারের যে পুরুষকর্তা তার অধীনের নারীদের বেপর্দায় রাখে)। আর তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এক. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান। দুই. মাদকাসক্ত ব্যক্তি। তিন. দানকৃত বস্তুর খোঁটা দানকারী ব্যক্তি।’ (নাসায়ি শরিফ)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতের হাওয়া পাঁচশত বছরের পথ অতিক্রম করে আসে। কিন্তু উপকার করার পর যে খোটা দেয়; পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি এবং মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি এ হাওয়ার পরশটুকুও পাবে না।’ (তাবারানি, জামে সগির)।

বদদোয়া থেকে সতর্কতা জরুরি : মা-বাবার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে তারা কষ্ট না পায়। খুব সতর্কভাবে তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। যাতে তারা সন্তুষ্ট থাকেন। খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন কখনো বদদোয়া না করেন- এটা তখনই সম্ভব যখন সন্তানের আচরণ হবে সন্তুষ্টজনক। মা-বাবা মনে কষ্ট পেয়ে বদদোয়া করলে সন্তানের জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। এটা অনিবার্য। কারণ মা-বাবার বদদোয়া মহান আল্লাহ নিশ্চিতভাবে কবুল করেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিন প্রকারের দোয়া অবশ্যই কবুল করা হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এক. নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া। দুই. মুসাফিরের দোয়া। তিন. সন্তানের প্রতি বাবার বদদোয়া।’ (ইবনে মাজাহ)।

পিতা-মাতার মর্যাদা : পিতা-মাতার মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, ‘আমার কৃতজ্ঞতা এবং তোমার পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করো।’ (সুরা লোকমান : ১৪)।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টির ওপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পিতা-মাতার অসন্তষ্টির ওপরই আল্লাহর সন্তুষ্টিনির্ভর করছে।’ হজরত মোয়াবিয়া ইবনে জাহাম সুহামি নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমার মায়ের সেবা করো। কিন্তু তিনি জিহাদে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ জানাতে থাকলে তিনি বললেন, হায় আফসোস! তোমার মার পা ধরে থাকো। ওখানেই তোমার জান্নাত।’ (ইবনে মাজাহ)।

মা-বাবার অবাধ্যতার ক্ষতি : মা-বাবার অবাধ্য সন্তান দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের রিজিকে ও আমলে বরকত থাকে না। ইবাদত কবুল হয় না। এ প্রসঙ্গে হাদিসে আছে, হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘তিন ব্যক্তি এমন রয়েছে, যাদের ফরজ ও নফল কোনো ইবাদতই আল্লাহতায়ালা কবুল করেন না। তারা হলো- পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, উপকার করে খোঁটা দানকারী এবং তাকদিরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। (কিতাবুস সুন্নাহ)।

অন্য হাদিসে আছে, হজরত সাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, ‘তিনটি বিষয় এমন, বর্তমানে যেগুলোর কোনো আমলই ফলপ্রসূ নয়। আর তাহলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা ও জিহাদ চলাকালে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা। (তাবারানি)। অন্য এক হাদিসে আছে, হজরত আবু বকর (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহতায়ালা তার ইচ্ছামাফিক অনেক গোনাহের শাস্তি কেয়ামতের দিন দেয়ার জন্য রেখে দেবেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতা এমনই একটি গোনাহ, যার শাস্তি আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতেই দিয়ে দেন।

শিক্ষণীয় ঘটনা : মা-বাবার অবাধ্যতা খুব মারাত্মক গোনাহ। দুনিয়ায়ই এর ফল ভোগ করতে হয়। হাদিসে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে এ বার্তাই পাওয়া যায়। হজরত ইবনে আবু আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত আলকামার মৃত্যু সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে। মৃত্যুকালে সে কোনোভাবেই মুখে তাওহিদের কালেমা উচ্চারণ করতে পারছিল না। এ সাহাবির প্রতি তার মা অসন্তুষ্ট ছিল। অতঃপর হজরত রাসুল (সা.)-এর সুপারিশে তার মা তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তখনই তার মুখে তাওহিদের কালেমা জারি হয়।

সন্তানের করণীয় : মা-বাবার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা। তাদের সেবা-যত্ন করা। বৃদ্ধ বয়সে তাদের সার্বিক খোঁজ-খবর রাখা। যথাসম্ভব আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করা। তারা কষ্ট পেতে পারে এমন আচরণ না করা। তাদের স্বাধীনভাবে ইবাদত করার পরিবেশ করে দেয়া। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করা। তাদের কাছে দোয়া চাওয়া। মা-বাবা অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের বদ মেজাজি প্রদর্শন না করা, চিৎকার করে কথা না বলা। প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর মা-বাবার জন্য দোয়া করা। মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের কবর জিয়ারত করা। তাদের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে দান-সদকা করা। মা-বাবার পরকালের জীবন সুন্দর ও শান্তিময় হওয়ার কামনায় সম্ভব হলে মসজিদণ্ডমাদ্রাসা বা এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা। পথশিশু-গরিব ও এদিমদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া।

লেখক : মুহাদ্দিস , উম্মেহানি (রা.) মহিলা মাদ্রসা, ইসলামবাগ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত