প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বেশ কিছুদিন থেকে রোগে ভুগছে লোকটি। আজ নয় কাল করে চিকিৎসকের কাছে যায়নি। একদিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল, আমার শিরাটায় হাত দিয়ে দেখুন তো ডাক্তার সাহেব। আগেকার দিনে হাতের শিরা দেখে রোগ নির্ণয়, তারপর চিকিৎসা করা হতো। কারণ, হাতের শিরার সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের সংযোগ। হৃৎপিণ্ড দেখা যায় না, অদৃশ্য। তাই হৃৎপিণ্ডের ভেতরের অবস্থা বুঝতে বাইরে থেকে যোগাযোগ আছে এমন কিছুর সাহায্য নেওয়া চাই। কারও মনের জগতে প্রেমের উন্মত্ততা বুঝতে হলে ব্যথায় কাতর তার দুটি চোখ দেখ। কারণ, চোখ অন্তরের আয়না। চোখের দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় লোকের মনের অবস্থা। মানুষের অন্তরের অবস্থার প্রতিফলন হয় চোখের ওপর।
নবীগণের মুজিজার কথা বলি, জড়পদার্থের ওপর মুজিজার প্রতিক্রিয়াতে সাগর দুভাগ হয়ে রাস্তা হয়ে গেছে। হাতের লাঠি আজদাহায় পরিণত হয়েছে বা আকাশের চাঁদ দুই টুকরো হয়েছে। সে দৃশ্য দেখে অনেকে নবী-রাসুলগণের সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করেছে, ঈমান এনেছে। তার মানে, মুজিজার প্রভাব প্রথমে জড়পদার্থকে আচ্ছন্ন করেছে, সেখান থেকে মানুষের অন্তরের ওপর এর প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এখন বল, যদি সেই প্রভাব জড়পদার্থের মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে সরাসরি মানুষের অন্তরের ওপর প্রতিফলিত হয় অবস্থা কেমন হবে? নিশ্চয়ই অদৃশ্য মালিকের সঙ্গে তার সংযোগ হয়ে যাবে।
বর জনদ আজ জানে কামেল মুজেজাত
বর জমিরে জানে তালেব চোন হায়াত
কামিলের প্রাণ থেকে উৎসারিত কারামাত
অন্বেষীর প্রাণের জন্য আনে জীবন-প্রভাত।
কাজেই কারও সাহচর্যে গিয়ে যদি তোমার প্রাণে সত্যিকার প্রেমের স্ফূরণ হয় বুঝবে যে, তিনি কামেল লোক এবং তার কারামাত তোমার জীবনকে আলোকিত করেছে। যদি এই রহস্য দেখার চোখ তোমার না থাকে, তাহলে নিরাশ হইও না, প্রকাশ্য আলামত দেখে তুমি তা উপলব্ধি করার চেষ্টা কর।
ন সববহা ও আসারহা মগজ ও পুস্ত
চোন বজুয়ি জুমলগি আসারে উস্ত
যত কার্যকারণ, নিদর্শন মগজ ও খোসার মতো
তারই নিদর্শন ছাড়া এসব কী হতে পারে, বল তো।
ডাক্তার তার হাত মুঠোয় নিয়ে শিরা পরীক্ষা করলেন। ডাক্তার বুঝতে পারলেন, এই রোগী ভালো হওয়ার লক্ষণ নেই। মানসিক রোগে আক্রান্ত। তাকে পরামর্শ দিলেন, তোমার জন্য চিকিৎসা হলো, তোমার মন যা চায় তাই কর। তোমার রোগ সারার এটিই ব্যবস্থাপত্র। অসুখ হলে অনেক কিছু বাছবিচার করে চলতে হয়। কিন্তু তোমার বেলায় বাছবিচার করলেই বেড়ে যাবে রোগ বালাই।
সবরো পরহিজ ইন মরজ রা দান জিয়ান
হারচে খাহাদ দিল দর আরশ দরমিয়ান
ধৈর্য ও বাছবিচার এই রোগের জন্য ক্ষতিকর
তোমার মন যা চায় তাই কর, তাতেই উপকার।
এমন ব্যবস্থাপত্রের কথা শুনে অসুস্থ লোকটির আনন্দ দেখে কে। মনের সবটুকু কৃতজ্ঞতা ডাক্তারের জন্য উজাড় করে সে যেতে যেত বলল, এখন থেকে আমার মন যা চায় তাই খাব, যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াব। আমি সম্পূর্ণ বাঁধনমুক্ত। একদিন সে ঘুরতে গেল একটি পুকুরপাড়ে। ছায়াঘেরা পুকুরপাড়ে নিসর্গের সব মায়া-মমতা যেন ঘিরে আছে বিকেলবেলা। একটু এগিয়ে দেখে পুকুর ঘাটে বসে হাত-মুখ ধুে এক ধুচ্ছেন এক লাক। সাদা মনের একজন সুফি। শরীরটা মোটা। রোগী বলল, এই লোক সুফির ভাব ধরেছে। সুফির পেছনে এসে দেখে, গর্দানটা বেশ মোটা। তার মন চাইল সুফির প্রশস্ত গর্দানে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেই। একবার চিন্তা করল, নির্দোষ লোকটিকে থাপ্পড় মারা, কাজটি কেমন হবে। আবার হিসেব করে, ডাক্তার তো বলেছেন, তোমার মন যা চায় তা কর, তাতেই তোমার অসুখ ভালো হবে। নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে কোরআনে নিষেধ আছে। সুফিকে থাপ্পড় না মেরে আমার মনের বিরুদ্ধে কাজ করা নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া নয় কি?। এমন কাজ তো আমি করতে পারি না, ডাক্তারের নির্দেশ আমাকে মানতে হবে। সন্তর্পণে দুই পা এগিয়ে একটা থাপ্পড় সজোরে বসিয়ে দিল সুফির গর্দানে।
বেচারা সুফি ব্যভাচেকা খেয়ে চমকে উঠে পেছনে তাকায়। ক্রোধে তার শরীরে আগুন ধরে যায়। কোত্থেকে এসে হারামি আমাকে এভাবে মারলে কেন? সুফির মন চাইল, কষে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দেই ইতরটার ঘাড়টায়। তার দাড়ি মোচ উপড়িয়ে জন্মের শিক্ষা দিই যেন বাপ-দাদার নাম ভুলে যায়। এখন সুফির যবানিতে মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, ‘সমাজে এমন মানুষ আছে যারা অন্যের দুঃখ দেখে আনন্দ পায়। কারও ক্ষতি করতে পারলে নিজেকে সফল ভাবে। এতে অন্যের ক্ষতির চেয়ে তাদের নিজেদেরই ক্ষতি হয় বেশি। এরা মানসিক রোগে আক্রান্ত। এদের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই অন্যের দোষ চর্চায় আনন্দ পায়। অন্যের কষ্ট দেখে খুশি অনুভব করে। আধুনিক মনস্তত্ব বিজ্ঞানও মওলানা রুমির এই ব্যাখ্যা ও ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে একমত। অসুস্থ লোকটিকে সম্বোধন করে মওলানা বলেন,
আই জানান্দে বি গুনাহান রা কফা
দর কফায়ে খোদ নমি বিনি জজা
ওহে যে নিরীহদের আঘাত কর পেছন থেকে
তোমার পেছনে শাস্তি অপেক্ষায়, দেখ না তাকে।
মওলানার পরিষ্কার কথা, তুমি যে মানুষের অগোচরে পেছন থেকে আঘাত কর, তুমি কি জান না তার বদলায় সমুচিত শাস্তি তোমার পেছনে অপেক্ষায় আছে? তুমি মনের কামনা-বাসনাকে মনে করেছ তোমার ডাক্তারের পরামর্শ। তাই তোমার অন্যায়ের পক্ষে মনে মনে যুক্তি সাজাও, তোমার কত যে বুদ্ধি। এই বুদ্ধির দৌড় দেখে দূর থেকে একজন হাসে। তার পরিচয়, সে তোমাকে এই কাজে নিয়োগদাতা। সে তোমার মনে কুমন্ত্রণা দেয়, তুমি অন্যায় কাজটি কর, হজম কর, অন্যায় পাপ তেমন কিছু নয়। তোমার কাজের পেছনে যুক্তি আছে, অধিকার আছে। আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়ার অধিকার গোনাহগারের আছে। তার পরিচয় শোনো, তোমার বাবা আদম ও মা হাওয়াকে সে বলেছিল, তোমরা আল্লাহর নিষিদ্ধ গন্দুম খাও তাহলে এই বেহেশতে চিরকাল থাকতে পারবে। শয়তান পেছন থেকে আঘাত করে আদম ও হাওয়ার ওপর। কিন্তু সেই আঘাতের বদলা সে হাতে নাতে পেয়ে যায়। আল্লাহর দরবার হতে বিতাড়িত হয় চিরতরে।
শয়তানের ধোঁকায় আদম পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু তাকে শেল্টার দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। তিনি আল্লাহর নবী ছিলেন বলে রক্ষা পেয়েছেন। তাকে সাপে দংশন করেছিল ঠিক; কিন্তু হাতে ছিল বিষ হরণ করার ওষুধ।
তোমার কাছে তো বিষ হরণের ওষুধ নেই। তুমি সাপুড়ে নও, কেন সাপ নিয়ে খেলা কর। ইবরাহিম খলিল (আ.)-এর মতো আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কি তোমার আছে? মুসা (আ.)-এর মতো লাঠির আঘাতে নীল নদের পানি ভাগ করে রাস্তা তৈরির শক্তি কি তোমার করায়ত্বে? কাজেই কিসের ভরসায় তুমি অন্যায়ের পথে চল আর মনে কর যে, আল্লাহ আমাকে মাফ করে দেবেন। যাদের ওড়ার প্রশিক্ষণ আছে, ছত্রীসেনার ডানা আছে তারা ওপর থেকে লাফ দিতে পারে, তুমি যদি মিনারে উঠে ছত্রীসেনার মতো লাফ দাও প্রাণটাই চলে যাবে। সার্কাসে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে হলে দীর্ঘ অনুশীলন দক্ষতা লাগে। এসবের তোয়াক্কা না করে তুমি যদি শূন্যে টানানো রশির ওপর হাঁটতে যাও, নির্ঘাত প্রাণ দিতে হবে। সেই সুফিকে দেখ, মনে করেছিল এক ঘুষিতে অসুস্থ লোকটির দফা রফা করবে; কিন্তু পরিণাম চিন্তা করে নিজেকে সংযত করে নেয় সে।
সাধক! তুমি যদি পরম অস্তিত্বের সন্ধানী হও অনস্তিত্বের মধ্যেই তাকে তালাশ কর। বিষয়টা কয়েকটি উপমা দিয়ে বোঝার চেষ্টা কর। নির্মাণ শিল্পী নিজের মধ্যে লুক্কায়িত শিল্পসৌন্দর্য প্রকাশের জন্য কোনো চোখ জুড়ানো প্রাসাদের কাছে না গিয়ে এমন জমি খুঁজে যেখানে কিছুর অস্তিত্ব নেই, অথবা ঘরবাড়ি ধ্বসে বিরানভূমি। কাঁধে নিয়ে পানি বিক্রেতারা নিজের কৃতিত্ব দেখানো জন্য শূন্য কলসি সন্ধান করে।
সূতার মিস্ত্রি তার শিল্পসৌন্দর্য প্রমাণের জন্য দরজা জানালা নেই- এমন বাড়ি তালাশ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, জীবন-জীবিকার বেলায় মানুষ যা নেই, অস্তিত্বহীন তাকে তালাশ করে। অনস্তিত্বকে অস্তিত্বে আনার জন্য শ্রমণ্ডসাধনা নিয়োজিত করে, জীবনের আরাম হারাম করে দেয়; কিন্তু যখন বিদ্যমান জগতের অন্তরালে লুকানো অদৃশ্য অস্তিত্বকে সন্ধানের প্রশ্ন আসে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়। নানা টালবাহানায় বলে যে, অদৃশ্য আবার কি। যা দেখা যায় না তা বিশ্বাস করব কেন। আমার প্রশ্ন হলো, এই জগতের অস্তিত্বহীন অদৃশ্য বিষয় তোমার কাছে সাক্ষাৎ অস্তিত্ববান মনে হয়, তাই তাকে লাভ করার জন্য প্রাণপাত কর, ঘুম হারাম হয়ে যায়। অথচ যে হাকিকত এখন ‘নেই’ এর মতো দেখায় তাকে সন্ধান করতে তোমার কোনো প্রস্তুতি নেই।
এসব প্রশ্নে সুফির হৃদয় ছিল আলোকিত। তাই মনে মনে বলল, এই ক্ষীণকায় লোকটাকে ঘুষি দিয়ে লাভ নেই। তাতে খুনের মামলায় জড়াতে হবে। তার চেয়ে ভালো, তাকে এখনই কাজীর দরবারে আদালতে নিয়ে যাই। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : খ, বয়েত : ১২৯৩-১৩৮২)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)