ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/১৯)

আবুল হাসান খারাকানির ঘরের শত্রু

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আবুল হাসান খারাকানির ঘরের শত্রু

ইরানে চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরার আগে ইচ্ছা হলো কয়েকজন বুজুর্গের কবর জিয়ারত করি। এরমধ্যে একজন সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)। আরেকজন শেখ আবুল হাসান খারাকানি। ইরানের বর্তমান সাধারণ সমাজে তারা তেমন পরিচিত নন। এর কারণ এখানে ব্যাখ্যা করতে চাই না। তেহরানের উত্তরাংশে তাজরিশে ফুটপাতে একটি কিতাব পেয়ে তাদের সম্পর্কে বিস্তাবিত জানার সুযোগ হলো। ‘সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামি’ শিরোনামের ফারসি ভাষার মোটা বইটি কিনতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম। বায়েজিদ বোস্তামি নামে একটি মাজার ও মাজারকেন্দ্রিক একটি লোকালয় আমাদের চট্টগ্রাম শহরের উত্তরাংশে এখনো বিদ্যমান। ফলে বইটির প্রতি আমার মনের আকর্ষণ বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। কিতাবখানা পড়ে জানলাম, তেহরান থেকে খোরাসান প্রদেশের রাজধানী মাশহাদ যাওয়ার পথে ৪০০ কিলোমিটারের ব্যবধানে শাহরুদ নগরী।

শাহরুদের অদূরে ভেতরে প্রাচীন বোস্তাম শহর। বর্তমান উচ্চারণে বাস্তাম। সেখানেই সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামি চিরনিদ্রায় শায়িত। তার মাজার থেকে উত্তরে তিন কোর্স (১৮ কিমি) এর ব্যবধানে আরেকজন বুজুর্গের মাজার, যার খ্যাতি ইতিহাসজোড়া। আমাদের দেশে ওয়াজের মাহফিলে বাঘের পিঠে সওয়ার বিষধর সাপ চাবুক বানানো বুজুর্গ হিসেবে তিনি পরিচিত। তার নাম আবুল হাসান খারাকানি (রহ.)। বায়েজিদ বোস্তামির করব জিয়ারত সম্পর্কিত একটি লেখা এর আগে আলাদাভাবে লিখেছি। লেখাটির শিরোনাম ‘বায়েজিদ বোস্তামি ও আবুল হাসান খারাকানি।’ লেখাটি মসনবি শরিফের গল্প ৪র্থ খণ্ডের ১৪৪তম প্রান্তরে সন্নিবেশিত এবং সেখানে আবুল হাসান খারাকানির আধ্যাত্মিক মর্যাদা সম্পর্কেও বর্ণনা আছে।

বোস্তাম থেকে দুপুরবেলা খারাকান যাব, একমাত্র যাতায়ত মাধ্যম মিনিবাস। গ্রাম্য পরিবেশে গাছগাছালির ভেতর দিয়ে ১৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে খারাকান পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। একটি অনুচ্চ টিলার ওপর শায়িত আছেন আবুল হাসান খারাকানি (রহ.)। মাজার বা আশেপাশের এলাকা মনে হলো জনমানবশূন্য। মাজারসংলগ্ন মসজিদের কাছে গিয়ে দেখলাম সেখানে এক লোক অপেক্ষায় আছেন। সালাম বিনিময়ের পর জানতে পারলাম। আমার মতো তেহরান থেকে এসেছেন জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। পরিচয় দিলেন আমি কুর্দি এবং আহলে তাসান্নুন (সুন্নি)। থাকি তেহরানে, একটি সংস্থায় চাকরি করি। আমার পরিচয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন ‘পিশে বায়েজিদে রফতি?’ বায়েজিদের কাছে গেছেন কি? বললাম, হ্যাঁ। সকালে সেখানেই ছিলাম। তিনি বললেন, জানো, চারবার বায়েজিদের জিয়ারত করলে এক হজের সওয়াব হবে। বললাম, জানি না, কখনো শুনিনি। মনে মনে বললাম, আল্লাহর দুনিয়ায় কত বিচিত্র মানুষ আছে। সাধারণ পোশাকের লোকটির মুখে দাড়ি বা ধার্মিকতার নিশানা নেই, তবুও এক ধরনের আধ্যাত্মিক আভা যেন ঝিলিক মারছিল তার চেহারায় অবয়বে। বিরক্তির সুরে বললেন, অনেকক্ষণ থেকে এসেছি। কেয়ারটেকার লোকটিকে বারবার অনুরোধ করেছি, অনেক দূর থেকে এসেছি, মাজারের দুয়ারটি খুলে দেন। কাছে বসে একটু দোয়া কালাম পড়তে চাই। কিন্তু এমন হারামি, কোনো সদুত্তর না দিয়ে চলে গেছে দুপুরের বিশ্রামে। তুমি যদি নিজের পরিচয় দাও, বিদেশি হিসেবে তোমাকে সম্মান করবে, আমিও জিয়ারতের সুযোগ পাব।

মাজারের পাশে প্রত্নতত্ত্বের নিযুক্ত লোকটির বাসা। দরজায় কড়া নাড়তে মনে হলো, ভদ্রলোক বিছানা থেকে উঠে এসেছেন। অসময়ে বিরক্ত করাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। পকেটের তাবিজটা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে এসে মাজারের দরজা খুলে দিয়ে বললেন, যাবার সময় আমাকে একটু জানাবেন, ‘তা দর রা কুফল কুনাম’ যাতে দরজা লক করতে পারি।

মসজিদের ভেতরের বিরাট পরিসর দেখে মনে হলো, এক সময় এখানে মসজিদকেন্দ্রিক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল। মসজিদের ভবনটি নতুনভাবে নির্মিত। তবে অতীতের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য তখনকার মেহরাবটি হুবহু অক্ষত রাখা হয়েছে। ইরান থেকে কেবলা পশ্চিম ও দক্ষিণ কোণা বরাবর। আগের মেহরাবটি যেভাবে কেবলামুখী ছিল তা বর্তমান মেহরাবের চেয়ে একটুখানি সোজা পশ্চিম দিকে। তাতে তখনকার কেবলার দিক নির্ণয়ের সঙ্গে এখনকার দিকনির্ণয়ের পার্থক্য স্পষ্ট। বর্তমান কেবলা নির্ণয়ে নিশ্চয়ই আধুনিক দিকনির্ণয় যন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, যা আগেকার দিনে সম্ভব ছিল না। তাই এই তফাৎ অযৌক্তিক নয়। ইরানি ঐতিহ্য প্রীতির প্রশংসনীয় দিকটি হলো, আগেকার কাঠামোর একটি অংশ শতশত বছর পরও সংরক্ষণ করা হয়েছে। উইকিপেডিয়ার দেওয়া তথ্যমতে, আবুর হাসান খারাকানি (রহ.)-এর জন্ম ৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যু ১০৩৩ সালে। তার মানে হাজার বছরের অধিককালের একটি নির্দশন এখনও অক্ষুণ্ণ। মাজারে প্রবেশ করে একেবারে কবরের সঙ্গে লাগোয়া আমরা দুজন পাশাপাশি বসে পড়লাাম। উভয়ে যার যার মতো করে দোয়া কালাম ফাতেহা পাঠ করলাম। কুর্দি ভদ্রলোক বললেন, আপনি মোনাজাত করেন। তার দোয়া কালাম পড়ার অবস্থা দেখে আমি বললাম, আপনিই মোনাজাত করেন। পরক্ষণে তার সাথে হাত তুললাম। সে কি দোয়া। তার হৃদয়মথিত কথা শেষ হয়েও হয় না। সবকথা ফারসিতে, মাঝেমধ্যে আরবিতে। ঈমান ও আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো উচ্চারণ তার মুখে শুনলাম না। অন্তত ৪০ মিনিট পর তার আর্তকান্না শেষ হলো। আমার মনটাও ভরে গেল অপার্থিব আনন্দে। লক্ষ্য করলাম, কবরের ওপরে কোনো কাপড় বা চাঁদোয়া নেই। সটান পাথরের ওপর খোদাই করে লেখা আছে একটি কবিতা। কবিতাটি ফারসি ভাষায় এবং মওলানা রুমির মসনবি শরিফ থেকে নেওয়া। সেই কবিতায় বর্ণনা আছে, কীভাবে তিনি বাঘের পিঠে চড়েছিলেন তার রহস্য। আমরা এখন সরাসরি মসনবি শরিফে চলে যাই।

রফত দরবেশি যে শহরে তালেকান

বাহরে সিতে বুল হুসাইনে খারেকান

এক দরবেশ লোক তালেকান শহর থেকে

গেলেন আবুল হানান খারাকানির খ্যাতির টানে।

মওলানা রুমি বলেন, তালেকান শহর থেকে এক দরবেশ সফর করলেন খারেকান অঞ্চলে। এই সফরের উদ্দেশ্য আবুল হাসান খারাকানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। পাহাড়-পর্বত, মরু-প্রান্তর পাড়ি দিয়ে ভক্তি ও আন্তরিকতা নিয়ে যেভাবে খারাকানে পৌঁছলেন তার বর্ণনা অনেক দীর্ঘ হবে। তাই কথা সংক্ষেপ করে আসল ঘটনায় চলে যাই। তরুণ সাধক দরবেশ গন্তব্যে পৌঁছার পর জেনে নিলেন শায়খে তরিকত- যার নামযশ খ্যাতি দুনিয়া জোড়া, তার বাড়ির ঠিকানা। শত ভক্তি মহ্বত নিয়ে তিনি শায়খের বাড়িতে ভয়ে ভয়ে কড়া নাড়লেন। বাড়ির ভেতর থেকে এক মহিলা উঁকি দিয়ে জানতে চাইলেন, কে তুমি, কি চাও, কার কাছে এসেছ? দরবেশ বললেন, শায়খের সঙ্গে মোলাকাতের আশায় এসেছি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে। এ কথা শুনে বিরক্তির স্বরে-

খন্দেয়ি যদ যন কে খাহ খাহ রিশ বিন

ইন সফরগিরিয়ো ইন তশবিশ বিন

হাসি দিল মহিলা হা হা আহম্মক কোথাকার

দীর্ঘ সফর, দুর্দশার কাহিনিও শোনায় আবার।

নিজ দেশে বুঝি বেকার ছিলে, নাকি মাথা খারাপ। এমন সফর করার বাতিক তোমাকে তাড়িত করল, কী ব্যাপার। ভবঘুরের নেশা মাথায় চেপেছিল, নাকি নিজের দেশের প্রতি ত্যক্ত বিরক্ত ছিলে। নাকি শয়তান তোমার গর্দানে জোঁয়াল চেপে সফরের কুমন্ত্রণা দিয়েয়েছিল, তাই এসেছ এখানে, মন্দ কপাল। মোটকথা মহিলা যতসব মন্দ অশালীন, গালিগালাজ করল এক নাগাড়ে। যার বর্ণনা দিতে আমি অক্ষম। সফরক্লান্ত দরবেশ ছিল আবুল হাসান খারাকানির মুরিদ। নিজের শায়খের সঙ্গে দেখা করতে এসে এমন আচরণে হতভম্ব দরবেশ।

আশকাশ আজ দিদে বেজসত ও গোফত উ

বা হামে আন শাহে শিরিন নাম কু

দুচোখ তার অশ্রুসিক্ত মহিলার কাছে জানতে চায়

অনেক তো বললেন, এবার বলুন শাহানশাহ কোথায়।

গোফত অন সালুস জাররাকে তুহি

দামে গুলান ও কমন্দে গোমরাহি

বলল, সেই প্রতারক, ফন্দিবাজ ভণ্ড

গোমরাহীর সরদার, বক সাধু বোকার হদ্দ।

তোমার মতো কত শত সরল মানুষ তার ধোঁকায় পড়ে পথ হারিয়েছে ইয়াত্তা নেই। কাজেই যদি তার সঙ্গে মোলাকাতের পরিবর্তে যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও, তাতেই তোমার মঙ্গল। তার কাজটাই হলো, বড় বড় আস্ফালন, মুফতো খাওয়া, পেটপূজা। তারপরও তার খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ-বিদেশে। যারা তার মুরিদণ্ডভক্ত তাদের অবস্থা বনি ইসরায়েলের গো-বাছুর পূজারিদের মতো। কেন তারা এই গরুর পূজা করে বুঝে আসে না আমার। মোটকথা শায়খ আবুল হাসান খারাকানির স্ত্রী স্বামীর অবর্তমানে তার বিরুদ্ধে এমন সব অরুচিকর মন্তব্য্য করে, যা সাধারণত ভণ্ডসুফদের বেলায় করা হয়। মহিলার ভাষা আরও তীর্যক-

জিফাতুল বাত্তাল আস্ত ও বাত্তালুন নাহার

হারকে উ শুদ গাররায়ে ইন তাবল খার

মুফতখোর এ ভণ্ডের যারা মুরিদ হয় একবার

রাতে মরা লাশ দিনের বেলা ভবঘুরে বেকার।

সুফি সাধনার ঘোরবিরোধী শেখ আবুল হাসান খারাকানির স্ত্রী আরও বলে, তুমি যার সাথে সাক্ষাতের জন্য এসেছ, সে তো পরের ওপর খায়, পেটপূজারি, যারা তার মুরিদের দলে ভেড়ে তাদের অবস্থা হয়, রাতে তাসবিহ জিকির ইবাদতের খবর নেই। নাক ডেকে ঘুমায়। আর দিনের বেলা কাজকর্ম করে না, বেকারের দল উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়। শতশত জ্ঞান হিকমতের পথ ছেড়ে এরা বুজুর্গির আস্ফালন দেখায়। হায় মুসা (আ.) কোথায়? তিইি এই গো-বাছুর পূজারিদের দমন করবে। শরিয়ত ও তাকওয়ার পথ বর্জনকারী এসব সুফির দলকে একমাত্র উমর (রা.) সৎকাজের আদেশ ও অসকাজের নিষেধ এর চাবুক দিয়ে শায়েস্তা করতে পারেন। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : বয়েত : ২০৪৪-২০৬৭)।

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত