ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আলী রজা কানুশাহ

সব্যসাচী সুফি সাধক ও সুফিতত্ত্ব বিশ্লেষক

ড. সেলিম জাহাঙ্গীর
সব্যসাচী সুফি সাধক ও সুফিতত্ত্ব বিশ্লেষক

আড়াইশ’ বছরের ইতিহাসে বাংলা সাহিত্যের মধ্য ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের কবি আলী রজা কানুশাহ (১৭৬০-১৮৩৫) যে আকর্ষণীয় মাত্রিক স্বতন্ত্র সত্তার অনবদ্য যুগের জন্ম দিয়েছিলেন, তা প্রায় বিস্মৃত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। প্রাতঃস্মরণীয় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অনুসন্ধানী গবেষণায় তা উঠে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে। ফলে কানুশাহের যে বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায় তা বাংলা সাহিত্যের সুফি ঘরানায় ইতিহাসের চর্চায় আকর্ষণীয় গবেষণার বিষয় হয়ে উঠছে ক্রমসম্প্রসারমাণ ধারায়। প্রাচীন যুগের মধুরামী ও দেবনাগরী লিপিতে তার ‘জ্ঞান সাগর’-সহ সমগ্র সৃষ্টি ছিল মূলত সুফিতত্ত্বের তাসাউফ জগতের কথকতায় ভরপুর। ফলে সাধারণে এগুলো বিস্ময় সৃষ্টি করলেও এর মর্মার্থ উদ্ধারের বিষয়টি তেমন পর্যালোচিত হয়ে উঠেনি। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ এবং ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি পর্যবেক্ষণে এ বিশেষত্ব উঠে এসেছে ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের’ মতো।

ক. আলী রজার জ্ঞান সাগর একটি দরবেশি গ্রন্থ। গুরুর উপদেশ ছাড়া এ রূপ গ্রন্থের মর্ম উপলব্ধি কঠিন। এ রূপ গ্রন্থে স্বভাবতই দুর্বোধ্য হয়ে থাকে। কবির ভাষায়ও অনেক স্থলে অস্পষ্টতা ও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তা ভাষা যেমনই হউক বঙ্গ সাহিত্যে এ শ্রেণীর গ্রন্থ আর নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয়না। (আলী রজা ওরফে কানু ফকির, ১৩৪২ ব, জ্ঞান সাগর, মুন্সী শ্রীযুক্ত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (সম্পা) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃষ্ঠা : ৭)।

খ. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায় আলী রজা শুধু পদকর্তা হিসেবে নয়, তাত্ত্বিক সাধক রূপেও এক যুগে বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি দরবেশ শাখা ভুক্ত হলেও হিন্দুর তন্ত্র ও যোগ শাস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। এ জন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই তার শিষ্য হয়েছিল।’ এ সব দৃষ্টান্ত থেকে আলী রজাকে এক অসাধারণ ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে। এ রকম অসাম্প্রদায়িক, উদার ও অধ্যাত্মমার্গের কবি ও সাধক মধ্যযুগের মুসলমান এবং হিন্দু সমাজে খুব সুলভ নয়। (অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০০৬-৭, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, মডার্ন বুক এজেন্সি, প্রা. লি. কলিকাতা, পৃষ্ঠা : ১৮২)। উচ্চতর গবেষণার আলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে উল্লিখিত দুই বিজ্ঞ পণ্ডিতের পর্যবেক্ষনের সারাংশ হলো- ১. এটি একটি দরবেশি গ্রন্থ। ২. ভাষায়ও অনেক স্থলে অস্পষ্টতা ও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। ৩. তিনি দরবেশ শাখাভুক্ত হলেও হিন্দুর তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। এজন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই তার শিষ্য হয়েছিল। এরকম অসাম্প্রদায়িক উদার ও অধ্যাত্ম মার্গের কবি ও সাধক মধ্যযুগের মুসলমান ও হিন্দু সমাজেও খুব সুলভ নয়। আমার পর্যবেক্ষণে কানু ফকিরের সৃষ্টি কর্মের মর্ম উদ্ধারের চেষ্টায় সাহিত্য বিশারদ ও অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে আন্তরিক প্রচেষ্টা তাতে বিষয়টির গভীরতর তাৎপর্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে চলেছে। কিন্তু দরবেশি ভাষা, ভাষার অস্পষ্টতা ও জটিলতা এবং হিন্দুর তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রবিষয়ক মন্তব্যগুলো স্থান, কাল, পাত্রের আলোকে গভীর থেকে গভীরতর পর্যায়ে অনুসন্ধান করতে পারলেই কানু ফকিরকে পরিপূর্ণ মাত্রায় আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে উঠবে। মুসলিম শিক্ষা-দীক্ষায় বেড়ে উঠা আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ‘দরবেশি ভাষা’ শব্দের ব্যবহার মূলত ইসলামধর্মের আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চতর জ্ঞান বাক্যের তাসাউফ পরিমণ্ডলের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। বলাবাহুল্য এ জগত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার সাথেই এর মর্মার্থ উদ্ধার গভীরভাবে সম্পর্কিত। হিন্দুধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষায় বেড়ে উঠা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেধা মননে হিন্দু ধর্মের তন্ত্র ও যোগশাস্ত্র প্রভাব বিস্তার করে আছে স্বাভাবিকভাবেই। তাই তিনি কানু ফকিরকেও ধারারই অনুসারী, অনুগামী হিসেবে বিবেচনা করেছেন অবলীলাক্রমে। যা পুনমূল্যায়ন অত্যাবশ্যক। আমাদের সৌভাগ্য, ‘দরবেশি ভাষা’ এবং ‘হিন্দু তন্ত্র ও যোগশাস্ত্র’ এ দুই বিষয়ে কানু ফকিরের পঞ্চম উত্তর পুরুষ, এ সাধক বংশের সমকালের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি দরবেশ মাওলার লিখিত দলিলে এটি সুষ্পষ্টভাবে জানার ক্ষেত্রে গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে।

লেখক : নজরুল গবেষক; ফিনল্যান্ডের ফিনিস একাডেমিতে সুফিতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণায় রত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত