ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/২৩)

অপাত্রে বন্ধুত্বের চরম খেসারত

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
অপাত্রে বন্ধুত্বের চরম খেসারত

জলাশয়ের ধারে এসে ইঁদুরের আহাজারী ব্যাঙের হৃদয়ে মাতম তোলে। বন্ধু ব্যাঙের কাছে ইঁদুরের আকুতি, তোমার বিহনে আমার দিন রাতে পরিণত হয়। তোমাকে না দেখলে আমার জীবনের আরাম হারাম হয়ে যায়। তুমি যদি বন্ধুত্বের জাকাত না দাও, আমার মিলন পিপাসা যদি নিবৃত না কর তাহলে মাটি হয়ে যাবে আমার দিনকাল।

অর্থবিত্ত বেশি হলে জাকাত দিতে হয়। বন্ধুত্ব ও সামাজিক মর্যাদারও এক প্রকার জাকাত আছে। তা হলো অসহায় মানুষের প্রতি দয়ার দৃষ্টি দান। এক হাদিসে বর্ণিত, আল্লাহতায়ালা মানুষকে দেওয়া ধন-সম্পদের যেমন হিসাব নেবেন, সমাজে যে প্রভাব ও মর্যাদা দিয়েছেন তারও হিসাব নেবেন। বলবেন, হে বান্দা, আমি তোমাকে প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়েছিলাম তার কি জাকাত তুমি আমাকে দিয়েছ? তুমি কি কোনো মজলুমকে সাহায্য করেছিলে অথবা কোনো দুঃখ ভারাক্রান্ত মানুষের চিন্তা লাঘব করেছিলে?

কথা বলতে এই ফকির দরিদ্র আদবের লেহাজ জানে না, বুঝলাম। কিন্তু তোমার যে সাধারণ দয়া তা তো আমার অযোগ্যতার অনেক ঊর্ধ্বে। তোমার দয়ার বিশালতা তো সবার জন্য অবারিত। সেই দয়া বরাদ্দের জন্য তো কোনো উসিলা খোঁজে না। সূর্যের প্রখর তাপ সবার জন্য উন্মুক্ত, অবারিত। ভালোমন্দ সবার ওপর সূর্যের প্রখর উত্তাপ সমানভাবে পতিত। কাজেই আমি অযোগ্য অপদার্থ হলেও তোমার দয়ার ছোঁয়া তো আমি পেতে পারি।

সূর্য যখন উত্তাপ ছড়ায় পশুর বিষ্ঠার ওপরও তা পতিত হয়। তাতে সূর্যের কিরণের মর্যাদার ঘাটতি হয় না। অথচ সেই তাপে গোবর শুকায়। তা জ্বালানি লাকড়িতে রূপান্তরিত হয়। দেখ, হাম্মামে আগুন জ্বলে সেই শুকনো গোবরের জ্বালানির জোগান পেয়ে। সূর্য শুধু হাম্মামের জ্বালানি যোগান দেয় না। জমিনকে তাপিত করে। যত ময়লা-আবর্জনা জৈব সারে রূপান্তরিত করে। তাতে শষ্য উদ্ভিদের সমারোহ জাগে বাগানজুড়ে।

জুযবে খাকি গাশতো রুস্ত আজ ওয়েই নবাত

ঘা কজা ইয়ামহুল ইলাহুস সাইয়ি আত

তুচ্ছ বিষ্ঠা সারে রূপান্তর হয় মাটির সঙ্গে মিশে

এভাবেই আল্লাহ মুছে দেন গোনাহ-খাতা নিমিষে।

যেভাবে ময়লা বিষ্ঠার রূপান্তর ঘটে সূর্যের উত্তাপে, সেভাবে আল্লাহ মানুষের বদ আমলকে বদলে দেন নেক আমলে। কোরআন মাজিদে তার প্রমাণ আছে। বয়েতের দ্বিতীয় ছত্রে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘তারা নয়, যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। আল্লাহ তাদের পাপগুলো পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। যে ব্যক্তি তওবা করে ও সৎকর্ম করে সে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ অভিমুখী হয়ে যায়।’ (সুরা ফুরকান : ৭০-৭১)। আল্লাহ তাদের পাপগুলো পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।’ কত বিরাট পুরস্কার।

বা হাদাস কে বত্তরিন আস্ত ঈন কুনাদ

কাশ নবাত ও নার্গিস ও নাসরিন কুনাদ

যে বিষ্ঠা অতি তুচ্ছ তার সঙ্গে যদি এমনটি করেন

উদ্ভিদ, নার্গিস-নাসরিন ফুলের সনে কি না করবেন।

বিষ্ঠা ময়লা-আবর্জনা গোবর পচা দুর্গন্ধের সঙ্গে যিনি এমন আচরণ করেন, চিন্তা করে দেখ, তিনি ফুলের বাগান, বন বনানী, নার্গিস নাসরিন, গোলাপ চামেলি জবা ও পারুলের সনে কী আচরণ করবেন। যারা খবিস পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত তাদের পাপগুলোকে পুণ্যে রূপান্তরিত করেন। এখন বল ইবাদত-বন্দেগির ফুল ও ফলের সঞ্চয় যাদের আছে, তাদের সঙ্গে তিনি কেমন আচরণ করবেন।

অন দাহাদ হকশান কে লা আইনুন রাআত

কে নাগুনজাদ দর জবান ও দর লোগাত

এমন দেবেন আল্লাহ তাদের কোনো চোখ যা দেখেনি

যার বর্ণনা সম্ভব নয় ভাষার সম্ভার ও অভিধান চষি।

পাপীদের যেখানে আল্লাহ এমন অবারিত দানে ধন্য করবেন সেখানে পুণ্যবানদের যা দেবেন তার বিবরণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। হাদিস শরিফে বর্ণিত, আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এমন বিষয়াদি প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি বা কোনো মানুষের কল্পনায়ও কোনোদিন আসেনি। এর পক্ষে যদি দলিল চাও, কোরআনের এই আয়াতখানি পড়ে দেখ- ‘কেউ জানে না তাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর কী লুক্কায়িত রাখা হয়েছে, তাদের কৃৎকর্মের পুরস্কারস্বরূপ।’ (সুরা সিজদা : ১৭)।

হাদিসে কুদসির এই বর্ণনার চেতনায় এসে মওলানার চিন্তা এখন সম্পূর্ণ বেকারার। বলেন, আমি তো তুচ্ছ, আমার সমগ্র অস্তিত্ব কুৎসিত আচরণে কলুষিত, তবুও আমি তোমার দয়ার ভিখারি। আমার অস্তিত্ব কাঁটার মতো। তার ওপর তুমি দাও ফুলের সমারোহ। আমার সাপের স্বভাবের ওপর তুমি পরিয়ে দাও ময়ূরের পেখম। গোনাহে পাপে হীনতাণ্ডনিচতায় আমি তো চরম অবস্থায়। অথচ তোমার দয়া দান মহানুভবতা আকাশের মতো প্রসারিত। তোমার রহমতের বরিষণে তাই ভিজিয়ে দাও আমার মনের তাপিত জমি।

হ্যাঁ বান্দা, তোমার জন্য সুসংবাদ আছে। দেখ, যদি দেখ মরুভূমির কোথাও সবুজের সমারোহ জেগেছে, ধরে নাও সেখানে পানির উৎসরণ হয়েছে। এ জন্যেই কোরআনে বলা হয়েছে, তাদের চেহারায় তুমি দেখবে সেজদার উদ্ভাস। তার মানে, ভেতরে পানির প্রস্রবণের প্রমাণ হলো, বালুচরে সবুজের উদ্গম। রাতে বৃষ্টি হয় কেউ দেখে না, সকালে উঠে গাছপালা উদ্ভিদে শান্তির প্রলেপ দেখে বোঝা যায়, রাতে রহমতের বৃষ্টি নেমেছিল। কাজেই তুমিও যে দয়াবান দয়াময়ের অসীম করুণায় সিক্ত হয়েছ, তার প্রমাণ তোমার মনের জমিন আর চেহারায় দ্বীনের ছায়ায় উদ্ভাসিত হবে।

এসব হাকিকতের কথা ব্যক্ত হবার পর গল্পের ধারাভাষ্যে ইঁদুর আবারও মিনতি জানাল, আমি ইঁদুর, আমি দেহের বস্তুর প্রতীক। নফসের দোসর। ডাঙায় আমার বিচরণ। আর তুমি ব্যাঙ জলে-স্থলে তোমার সমান বিচরণ। কারণ, তুমি রূহের প্রতীক। এসো হে রুহ! নফসের সঙ্গে প্রীতির ডোরে আবদ্ধ হও। আমরা বন্ধু হই দুজনে। কারণ, একে অন্যের সাহায্য ছাড়া আমাদের জীবন সার্থক হবে না কিছুতেই। নফসরূপী ইঁদুরের প্রস্তাব শুনে রুহরূপী ব্যাঙ মনে খটকা অনুভব করে। কিন্তু তাকদিরের ফয়সালা এসে বিচক্ষণ লোকদের দৃষ্টিকেও অন্ধ করে ফেলে। এমন অবস্থায় তোমার করণীয় কী?

সাদ দিদি শোকর কুন ঈসার কুন

নাহস দিদি সাদকা ও ইসতেগফার কুন

সৌভাগ্য দেখ তো শোকর কর, ত্যাগ স্বীকার কর

অলুক্ষণ দেখ যদি দান-সদকা, ইস্তেগফারের পথ ধর।

তুমি যদি অনুভব কর যে, সৌভাগ্যের সেতারা তোমার ভাগ্যাকাশে উদিত হয়েছে। সুন্দর গঠনমূলক চিন্তাধারা তোমার কল্পনায় জেগে উঠেছে, তাহলে আল্লাহর কাছে শোকর আদায় কর, ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে সেই সৌভাগ্যকে আলিঙন করার চেষ্টা কর। আর যদি দেখ যে, তোমার মাথায় চিন্তায় শুধু খারাপ চিন্তার উদ্রেক হয়, নেতিবাচক ধারণা কল্পনায় তুমি তাড়িত হও, তাহলে নিজেকে শোধরে নাও, দান সদকা করে বালা-মুসিবত থেকে রেহাই পাওয়ার পথ খোঁজ। ইসতেগফার ও তওবা কর। তোমার রুহকে তখন বাজে চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখ, তখনই তোমার দিলের আকাশে সৌভাগ্যের সেতারার উদয় হবে।

শেষ পর্যন্ত নফসের প্রস্তাবে রুহ রাজি হয়ে যায়। ঠিক হয় একটি রশির এক মাথা বাঁধা থাকবে ইঁদুরের পায় আর অপর মাথা বাঁধা থাকবে ব্যাঙ এর পায়ে। ইঁদুর যখন ব্যাঙের সাক্ষাতে আসবে, জলাশয়ের পাড়ে এসে রশিতে টান দেবে। তখন ব্যাঙ উঠে আসবে জলাশয়ের পাড়ে। কথামতো একদিন ইঁদুর জলাশয়ের কাছে আসে। উদ্দেশ্য, রশিতে টান দিয়ে ব্যাঙকে তার উপস্থিতির কথা জানান দেবে; ঘটনাক্রমে ইবলিশ দাঁড়কাক এসে ইঁদুরকে ছোঁ মেরে উড়াল দেয় আকাশে। রশির টানে জলাশয়ের ব্যাঙও ঝুলে যায় বাতাসের গায়ে। আজব এই দৃশ্য দেখে লোকেরা বলাবলি করে, কেমন দড়িবাজ কাক দেখ। পুকুর সেচে ব্যাঙ শিকার করেছে, বাতাসে ঝুলছে দেখা যায়। ব্যাঙ তখন নিজের কপালকে দায়ী করে জনতার জিজ্ঞাসার জবাব দেয়, কাকের বাহাদুরি নয়। বরং আমার অপাত্রে বন্ধুত্বের খেসারত দিচ্ছি ইঁদুরের সঙ্গে একরশিতে ঝুলে। মওলানা সতর্ক করেছেন, খবরদার, তোমার রুহকে আধ্যাত্মিকতার জলাশয় ছেড়ে নফস ইঁদুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে দিও না। তখন নফস কামনা-বাসনার রশিতে বন্দি করে তোমার এমন দশা ঘটাবে, যার ফলে ইবলিশ যখন নফসকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে হাত-পা বাঁধা রুহের, তখন কিছুই করার থাকবে না।

চগ্জ গোফতা ইন সাজায়ে হার কাসি

কু চো বি আবান শওয়াদ জুফতে খাসি

ব্যাঙ বলল, এ হলো শাস্তি সেই ব্যক্তির প্রাপ্য

বেপরোয়া বন্ধুত্বে নিচণ্ডহীনদের সঙ্গে যার সখ্য।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ২৬৯৮-২৯৭৩)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত