প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫
ইসলাম মদকে শুধু ব্যক্তিগত নেশা হিসেবে দেখেনি; বরং একে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের মূল হিসেবে ঘোষণা করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধু মদপান করাকে নিষিদ্ধ করেননি; বরং মদের সঙ্গে সামান্যতম সম্পৃক্ততার প্রতিও কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন। আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, মদের সঙ্গে সম্পৃক্ত দশ শ্রেণির লোককে রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। এরা হলো- মদ তৈরিকারী, মদের ফরমায়েশকারী, মদপানকারী, মদবহনকারী, যার জন্য মদবহন করা হয়, মদপরিবেশনকারী, মদবিক্রয়কারী, এর মূল্য ভোগকারী, মদ ক্রেতা এবং যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়।’ (তিরমিজি : ১২৯৫)।
হাদিসের সারমর্ম : রাসুলুল্লাহ (সা.) এই হাদিসে মদের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত দশ শ্রেণির মানুষকে অভিসম্পাত করেছেন। লানাত মানে হচ্ছে- আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকা। অর্থাৎ, এই দশ শ্রেণির লোকেরা এমন এক গুরুতর গোনাহের সঙ্গে যুক্ত, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ঘৃণার কারণ।
হাদিসের ভষ্যমতে উক্ত দশ শ্রেণি হলো-
১. মদ তৈরিকারী : যে আঙুর বা অন্য ফল চেপে মদ তৈরি করে।
২. যার জন্য তৈরি করা হয় : যে অর্ডার দেয় বা তৈরি করায়।
৩. মদপানকারী : যে নিজে পান করে।
৪. বহনকারী : যে পরিবহন করে।
৫. যার কাছে পৌঁছানো হয় : যার জন্য বহন করা হয়।
৬. পরিবেশনকারী : যে ঢেলে দেয় বা পরিবেশন করে।
৭. বিক্রেতা : যে মদ বিক্রি করে।
৮. মূল্যভোগকারী : যে মদের বিক্রয়মূল্য খায় বা ভোগ করে।
৯. ক্রেতা : যে ক্রয় করে।
১০. যার জন্য ক্রয় করা হয় : যার হয়ে অন্য কেউ ক্রয় করে আনে।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘এই হাদিস প্রমাণ করে যে, মদ সম্পর্কিত সব ধরনের সহযোগিতা- তৈরি, বিক্রি, পরিবহন, অর্থ লেনদেন ইত্যাদি- প্রত্যেকটিই হারাম। এমনকি যে পরোক্ষভাবে মদের প্রসারে ভূমিকা রাখে, সেও গোনাহে শরিক।’ (শারহু মুসলিম, খণ্ড : ১৩, পৃষ্ঠা : ১৬০)। তিনি আরও বলেন, এখানে ‘লানত’ শুধু মদপানকারীর জন্য নয়, বরং মদের ব্যবসায়িক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চক্রে যুক্ত সকলের ওপর আল্লাহর অভিশাপ।
ইমাম ইবনু হাজার আল-আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মদ সম্পর্কিত দশজনের ওপর অভিসম্পাত করেছেন- এর দ্বারা বোঝা যায়, মদের বিষয়টি শুধু ‘পান’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি এমন এক অপরাধ, যার প্রতিটি স্তরই আল্লাহর ক্রোধ আহ্বান করে।’ (ফাতুহুল বারি, খণ্ড : ১০, পৃষ্ঠা : ৪৫)।
তিনি আরও বলেন, ‘যে কেউ এমন কাজে সহযোগিতা করে যা হারামকে শক্তিশালী করে, সে পাপের অংশীদার। যেমন, মদের পাত্র বানানো, পরিবহন করা, সংরক্ষণ করা, এমনকি মদের বিজ্ঞাপন করা- সবই এ নিষেধের আওতায় পড়ে।’
ফিকহি ব্যাখ্যা
মদ বিক্রয় হারাম ও অবৈধ আয় : ইবনু কুদামা বলেন, ‘মদের মূল্য ভোগ করা হারাম, কারণ আল্লাহ ও তাঁ রাসুল তা ‘অশুচি’ ও ‘নাজিস’ ঘোষণা করেছেন।’ (আল-মুগনি, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ১৫২)।
মদের ব্যবসা বা সহযোগিতায় চাকরি করাও হারাম : ইমাম নববী বলেন, ‘যে ব্যক্তি জানে তার কাজ মদের বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, সে আয় হালাল নয়।’ (আল-মাজমু, খণ্ড : ৯, পৃষ্ঠা : ২৩৩)।
সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে শিক্ষা : এই হাদিস আজও প্রযোজ্য- মদের কারখানা, বিয়ার বা ওয়াইন কোম্পানিতে কাজ করা, মদ পরিবহনকারী ট্রাক চালানো, হোটেল, রেস্টুরেন্টে মদ পরিবেশন করা, শেয়ারবাজারে অ্যালকোহল কম্পানির শেয়ার কেনা, এমনকি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার করা- সবই এই হাদিসের অন্তর্ভুক্ত নিষিদ্ধ কর্ম। রাসুল (সা.)-এর এই অভিসম্পাতপূর্ণ বাণী আমাদের শেখায় যে, মদ শুধু ব্যক্তিগত নেশা নয়, বরং একটি সামাজিক ব্যাধি। ইসলামি শরিয়া এর প্রতিটি স্তরে মদ সংস্কৃতিকে নির্মূল করতে চায়। যে সমাজে মদের উৎপাদন, বাণিজ্য ও প্রচলন থামবে, সেখানে নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক নিরাপত্তা দৃঢ় হবে।