ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী
ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ

বাংলাদেশের মুসলিম ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ। কালের সাক্ষী হয়ে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা স্থাপত্যটি দেশের পুরোনো স্থাপত্যগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তরপাশে সুন্দরঘোনা গ্রামের অবস্থিত অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদটি। মসজিদটি এক নজর দেখতে ও সেখানে দু-চার রাকাত নামাজ পড়তে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিদিনই শত শত লোক ভিড় করছেন সেখানে।

মসজিদটিতে প্রবেশ করতে হলে পুরোনো মাঝারি আকৃতির গেটের আশ্রয় নিতে হয়। শ্যাওলা ধরা পাকা ইটের গেট পেরোলেই মসজিদের দরজা বরাবর সরু পথ। দু’পাশে নাম না জানা নানা ফুলের সমারোহ। মসজিদের চারপাশে ছোট্ট খালি সবুজ প্রান্তর। গাছের ডালে বসা হাজারও পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে মসজিদের আশপাশ।

মসজিদের বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির আস্তরণ। খসে পড়েছে অনেকটাই। শ্যাওলা জমে কালো হয়ে আছে অনেকাংশ। অপূর্ব সব শিল্পকর্মে ঠাসা। শত শত বছর আগে এত সুন্দর আশ্চর্যজনক স্থাপনা কীভাবে তৈরি হয়েছিল, সেটাই বিস্ময়ের। মসজিদের ভেতরটাও অদ্ভুত সুন্দর। সারি সারি পিলারগুলো ছাদ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের গম্বুজের জায়গাগুলো ভেতরের দিকে ফাঁকা। দেখতে বেশ সুন্দর দেখায়। দেয়ালে পোড়ামাটি দিয়ে গড়া লতাপাতার অপূর্ব শিল্পকর্ম।

ইতিহাসের খোঁজে : স্থানীয়দের থেকে জানা যায়, ১৪৩৫-৫৯ সনের শাসক সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। পনের শতকের দিকে খানজাহান বহু টাকা ও সময় খরচ করে এ মসজিদটি তৈরি করেন। পোড়ামাটির ফলক ও পাকা ইটের তৈরি অনন্য স্থাপত্য এটি। বাইরের দিক থেকে মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং বাইরের পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু। মসজিদের ভেতরে মেঝে হতে ছাদের উচ্চতা প্রায় ২১ ফুট। মসজিদের চার কোণে রয়েছে ৪টি মিনার। এগুলোর নকশা গোলাকার। ওপরের দিকটা খানিকটা সরু। এগুলোতে নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে টালি ইট, চুন-সুড়কি, টেরাকোটা মাটির ফলক। সামনের দুটি মিনারের একটির নাম ‘রওশন কোঠা’ এবং অন্যটির নাম ‘আন্ধার কোঠা’। মিনারের ভেতরে রয়েছে প্যাঁচানো সিঁড়ি। আগে এই মিনারের ওপর থেকে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এখন বন্ধ পড়ে আছে।

‘ষাট গম্বুজ’ মসজিদ কেন? : মসজিদের গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি। ৭০টি গম্বুজের উপরিভাগ গোলাকার। মাঝের একটি সারিতে চার কোণবিশিষ্ট ৭টি গম্বুজ আছে। মিনারে রয়েছে আরও ৪টি গম্বুজ। এ হিসেবে গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৮১টি। ষাটের অধিক গম্বুজ হওয়া সত্ত্বেও মসজিদটির নাম কেন ষাট গম্বুজ হলো- এ নিয়ে বেশ কয়েকটি মত চালু রয়েছে লোকসমাজে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, মসজিদের ঘাটটি থামের অস্তিত্ব থেকে এর নাম হয় ‘ষাট খাম্বাজ’। কালের বিবর্তনে এরই কথ্যরূপ হয় ‘ষাট গম্বুজ’। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজের সারি আছে বলে মসজিদের নাম হয় ‘সাত গম্বুজ’; পরে তা থেকে ‘ষাট গম্বুজ’ নাম হয়েছে। তবে স্থানীয়রা জানান, মসজিদের ভেতরের ৬০টি পিলার থেকেই আসলে ৬০ গম্বুজ মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে। কারণ, ফার্সিতে পিলারকে গম্বুজ বলে।

মসজিদের ভেতর : মসজিদের সামনের দিকের মাঝখানে রয়েছে একটি বড় খিলান। তার দুই পাশে আরও পাঁচটি করে ছোট খিলান। পশ্চিম দিকে মূল মেহরাবের পাশে রয়েছে ২৬টি দরজা। ধূসর বেলে পাথরে নির্মিত মূল মেহরাবটি মুসলিম রীতির আদলে অপূর্ব চিত্রকর্মে ভরপুর। মেহরাবগুলোর সামনের অংশটা খানিকটা খাঁজকাটা। যদিও এগুলোর অধিকাংশ অলঙ্করণ বর্তমানে বিলীন, তবুও এখনকার চিত্রকর্ম দেখে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এগুলো পোড়ামাটি দ্বারা চমৎকারভাবে অলঙ্কৃত ছিল।

মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে বিশাল একটি দীঘি। রোদ্দুরে ক্লান্ত দুপুরে দিঘির জল ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা বাসাতে মন জুড়িয়ে যায় মুহূর্তে। পাশেই রয়েছে হজরত খান জাহান আলি (রহ.)-এর বসতভিটা।

আছে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি : মসজিদটির স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে দিল্লি ও লাহোরের বাদশাহী মসজিদের মিল রয়েছে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া শরইয়্যাহ পাগাড়, টঙ্গী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত