ঢাকা শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা

নির্বাচনমুখী হওয়া জরুরি
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা

আগামী জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে এক ধরনের গোলক ধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ-জামান এক সাক্ষাৎকারে আঠারো মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছিলেন। তখন সবাই নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের ধারণা পায়। গত ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বছরের ডিম্বের বা ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলেন। এর দুয়েক দিন পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে উল্লেখ করেন। বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তারা সরকারের কাছ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ চায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বলেছিলেন, নির্বাচনি ট্রেন চলতে শুরু করেছে। অল্প কিছু সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সময় উল্লেখ করা হচ্ছে না। সাম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। সেনাপ্রধানও এর সাথে একমত পোষণ করেছেন। তবে সম্প্রতি বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে নির্বাচন হবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রাইট টু ফ্রিডমের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম বি মাইলামের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি বলেন, এ বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এভাবে একেক সময় একেক কথা বলায় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। তার কথার মধ্যে কোনো স্থিতি নেই। এটি নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা প্রকাশ করে। কথার এই হেরফের প্রধান উপদেষ্টার ইমেজের জন্য ক্ষতিকর। অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতাও প্রকাশ করে। অথচ ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন দৃঢ়চেতা ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। তিনি যখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাবৎ বিশ্ব কীভাবে তাকে গ্রহণ ও শ্রদ্ধা করেছে, তা দেশের মানুষ দেখেছে। এটা আমাদের জন্য এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। দেশের মানুষের আশা, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সকল রাষ্ট্র কাঠামো যেভাবে ধ্বংস করে গেছেন, তা পুনর্গঠন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষেই সম্ভব। ফ্যাসিবিরোধী সব রাজনৈতিক দলও তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। তারা সরকারকে নিজেদের মনে করে তাকে ব্যর্থ না হতে দেয়ার অঙ্গীকার করে। সরকার যখনই কোনো সমস্যা ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়েছে, তখনই দলগুলো পাশে দাঁড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই। এর স্থায়িত্ব কতদিন হবে, সরকারও তা নির্দিষ্ট করেনি। তবে সরকার গঠনের পরপর সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ-জামান আঠার মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলে সরকারের একটি সময়সীমার ধারণা দেন। এখনো তিনি এই সময়সীমার মধ্যে দৃঢ় রয়েছেন। এরইমধ্যে সরকারের সাত মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সাত মাসে এগারটি সংস্কার কমিশন গঠন এবং সেগুলোর অধিকাংশের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল চায়, পুরো সংস্কার শেষ না করে নির্বাচন দেয়া যাবে না। বৃহৎ দল বিএনপি বারবারই বলে আসছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার এসে করবে। দলটির যুক্তি, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, সরকার তত বেশি সমস্যার মুখোমুখি হবে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। সরকারও নির্বাচন নিয়ে একবার ডিসেম্বর, একবার ডিসেম্বর টু মার্চ, আবার ডিসেম্বর টু জুন বলে এক ধরনের ধাঁধা সৃষ্টি করে ফেলেছে। কথার মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। এতে সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দ্বিধাগ্রস্ততা প্রকাশিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো দল দ্রুত নির্বাচনের কথা বললে সরকার ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বলে। আবার নতুন একটি দল যখন বলল, এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, তখন সরকার আবার আগামী মার্চে বা জুনে নির্বাচনের কথা বলেছে। এর মধ্যে ‘যদি’, ‘কিন্তু’র এক অনিশ্চয়তা রেখে দেয়া হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভরসা যথেষ্ট রয়েছে। বিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন বিস্তৃত। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে তিনি তার ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেণ। তার মতো একজন ব্যক্তি যখন জাতীয় নির্বাচন হওয়া নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলেন, তখন তা মানুষের কাছে শোভনীয় মনে হয় না। এটা তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না এবং তা কাম্য হতে পারে না। আগামী নির্বাচন কবে হবে, এ ব্যাপারে একেক সময় একেক কথা না বলে এবং ‘যদি’, ‘কিন্তু’ থেকে বের হয়ে তার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া উচিত। অনিশ্চয়তা থাকলে সরকারের প্রতি জনআস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাবে। এরইমধ্যে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে সরকারের ইমেজ সংকট দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, সরকারের উচিত হবে, যতটুকু সংস্কার দরকার তা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। অবিলম্বে একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। অন্যকোনো চিন্তা করার সময় ও সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। সরকারকে এ বিষয়টি মাথায় রেখে নির্বাচনমুখী হওয়া জরুরি। এর কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত