ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বর্ষায় বৃক্ষরোপণ : জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণের ভূমিকা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বর্ষায় বৃক্ষরোপণ : জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণের ভূমিকা

প্রতিবছর বর্ষা আসে বৃষ্টির ছোঁয়ায় জীবনকে সজীব করে তুলতে। এই ঋতু শুধু প্রকৃতিকে নয়, মানব সমাজকেও এক নতুন সম্ভাবনার বার্তা দেয়। কারণ বর্ষা মৌসুম বৃক্ষরোপণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। যখন মাটি আর্দ্র থাকে, তখন নতুন গাছ লাগানো ও বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়। বর্তমান বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বর্ষায় এই উদ্যোগ কার্যকর ফল দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

বৃক্ষরোপণের পরিবেশগত গুরুত্ব : বৃক্ষ প্রকৃতির ফুসফুস। তারা বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ করে, কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ধূলিকণা প্রতিরোধ করে। এক হেক্টর বনভূমি বছরে প্রায় ২.৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এতে বায়ুদূষণ কমে এবং মানুষের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। গাছপালা ভূমিক্ষয় রোধ করে, ভূগর্ভস্থ পানি ধরে রাখে এবং খরা ও বন্যার প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।বর্ষায় রোপিত গাছ সহজে মাটিতে শিকড় গাঁথতে পারে। ফলে গাছের বেড়ে ওঠা এবং টিকে থাকা দুইই সহজ হয়।

বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব : বিগত কয়েক দশকে বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। বর্ষাকালে বৃক্ষরোপণ এ পরিবর্তনের মোকাবিলায় সহায়তা করে। প্রতি বছর লাখ লাখ গাছ কাটা হচ্ছে- নগরায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ ও কাঠের জন্য। এই অপূরণীয় ক্ষতি রোধ করতে হলে রোপণই একমাত্র উপায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ১ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম। তাই যদি আমরা বর্ষায় ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করি, তবে ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সহনশীল পৃথিবী রেখে যেতে পারি।

পরিবেশের ভারসাম্য : গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে পরিবেশকে পরিষ্কার রাখে।

মাটির স্বাস্থ্য : গাছের শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে, যা ভূমি ক্ষয় রোধ করে এবং মাটির উর্বরতা বাড়ায়।

জলবায়ু পরিবর্তন: গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে সহায়ক।

জীববৈচিত্র্য : বিভিন্ন ধরনের গাছপালা বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও পোকামাকড়ের আবাসস্থল সরবরাহ করে, যা জীববৈচিত্র্যকে সমর্থন করে।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব: গাছপালা কাঠ, ফল, ভেষজ এবং অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ সরবরাহ করে, যা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সৌন্দর্য: গাছপালা আমাদের চারপাশের পরিবেশকে আরও সুন্দর করে তোলে।

স্বাস্থ্য: গাছপালা আমাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৃক্ষরোপণ ও বর্ষা : বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ যেখানে বর্ষা মৌসুম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষার সময় গড় বৃষ্টিপাত হয় ৭০%-এর বেশি। এই সময়টিতে মাটি কোমল ও আর্দ্র থাকে, যা গাছ লাগানোর জন্য আদর্শ। সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর এই সময়টিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, কৃষক, স্বেচ্ছাসেবক ও প্রবাসীরা একত্রিত হয়ে গ্রাম ও শহরজুড়ে গাছ লাগায়। বিভিন্ন জায়গায় মেলা ও প্রচারণার মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্ষায় কোন গাছ রোপণ উপযুক্ত? বর্ষায় যে গাছগুলো সহজে বেঁচে থাকে ও দ্রুত বেড়ে ওঠে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ফলজ গাছ: আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, জামরুল, নারিকেল বনজ গাছ: মেহগনি, শাল, গামারি, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস ঔষধি গাছ: নিম, অর্জুন, বহেরা, হরিতকি, তুলসী শোভাবর্ধক গাছ: কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কনকচূড়া এই গাছগুলো রোপণ করলে শুধু পরিবেশই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভবান হওয়া সম্ভব।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপকারিতা : বৃক্ষ রোপণ শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, বরং এটি অর্থনৈতিকভাবে মানুষকে স্বাবলম্বী করতে পারে। একজন কৃষক যদি তার জমিতে সঠিক পরিকল্পনায় ফলজ ও বনজ গাছ লাগায়, তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে তা থেকে আয় শুরু করতে পারে। নারকেল, সুপারি, আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলজ গাছ চাষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব। এছাড়া বনজ গাছ কাঠ, জ্বালানি ও গৃহনির্মাণে ব্যবহৃত হয়ে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা : শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বর্ষা মৌসুমে বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অত্যন্ত কার্যকর। শিক্ষার্থীরা যদি ছোটবেলা থেকেই গাছ লাগানো ও পরিচর্যার সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে ভবিষ্যতে তারা পরিবেশবান্ধব জীবনধারায় অভ্যস্ত হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ নামে গাছ লাগানোর সুযোগ তৈরি করলে তারা সেই গাছকে সন্তানের মতো যত্ন নেবে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠবে।

বৃক্ষরোপণে নারীদের অবদান : নারীরা ঘর ও সমাজ গঠনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তেমনি পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও তাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। গ্রামে নারীরা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত গাছ যেমন- কচু, লাউ, পাতিলেবু, তুলসী, নিম ইত্যাদি লাগিয়ে পরিবারকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে সহায়তা করে। সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলো নারীকে প্রশিক্ষণ ও বৃক্ষ বিতরণের মাধ্যমে এই কাজে সম্পৃক্ত করতে পারে। নারীদের সম্পৃক্ততা বৃক্ষরোপণ আন্দোলনকে সফল করে তুলবে।

বৃক্ষরোপণ ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি : ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মসহ সব ধর্মেই বৃক্ষরোপণকে একটি পুণ্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কিয়ামত কিয়ামতের দিনই হয়, আর তোমার হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তবে সেটি লাগিয়ে দাও।’ এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, বৃক্ষরোপণ শুধু পরিবেশগত নয়, বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্বও বটে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত