ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মানসিক সক্ষমতা আইনের যৌক্তিকতা

হাসান আলী
মানসিক সক্ষমতা আইনের যৌক্তিকতা

মানসিক সক্ষমতা আইনের উদ্দেশ্য হলো- মানসিকভাবে সক্ষমতাহীন ব্যক্তি যারা সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম তাদের অধিকার সুরক্ষা করা। সর্বোত্তম স্বার্থে তাদের জন্য প্রতিনিধি নিযুক্ত করা। স্বচ্ছ, মানবিক, নায্যপদ্ধতিতে মানসিক সক্ষমতার মূল্যায়ন বা প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সহায়তা প্রদান করা। মানসিক সক্ষমতা মানে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি নিজের কল্যাণে বা ইচ্ছা পূরণে সজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পরিচালনা করতে সক্ষম। ব্যক্তির এই সক্ষমতা আছে কি না, তা অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে সুনির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে। সক্ষমতা মূল্যায়ন পদ্ধতি হতে পারে পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক এবং আদালতের মাধ্যমে গঠিত বোর্ড দ্বারা। ব্যক্তি যদি ভবিষ্যতে মানসিক সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা থেকে নিজের কল্যাণে পছন্দমতো কাউকে প্রতিনিধি মনোনীত করে তবে তা বৈধ বিবেচিত করা হবে।

এই আইন প্রণয়নের সময়ে ব্যক্তির মানবাধিকার সুরক্ষা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা, অপব্যবহার ও নির্যাতন প্রতিরোধ, সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামো রাখা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। ডিমেনশিয়া, দুরারোগ্য ব্যাধি, স্ট্রোক করার কারণে বা দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে জ্ঞান হারালে কিংবা যৌক্তিক মতামত দিতে অক্ষম হলে মানসিক সক্ষমতার আইনে ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা এবং সঠিক সেবা নিশ্চিত করা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে। ব্রিটেনে মানসিক সক্ষমতা আইন ২০০৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি যুক্তরাজ্যের সংসদের একটি আইন যা ইংল্যান্ড এবং ওয়েলেসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো প্রাপ্ত বয়স্কদের পক্ষে কাজ করার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রদান করা, যাদের নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই।

ইংল্যান্ডের মেন্টাল ক্যাপাসিটি এ্যাক্ট ২০০৫-এর মতো আধুনিক এবং ব্যাপক মানসিক সক্ষমতা আইন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ডে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি কোনো ফেডারেল আইন নেই, যা ইংল্যান্ডের মেন্টাল ক্যাপাসিটি অ্যাক্টের সমান, তবে স্ট্যাট গার্ডিয়ানশীপ লজ ও ডুরাবল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এর মাধ্যমে অনুরূপ কাজ করা হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইন সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো। মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ এর ২(১৬) ধারায় বলা হয়েছে, মানসিক রোগ অর্থ মানসিক প্রতিবন্ধিতা এবং মাদকাসক্তিসহ ক্লিনিক্যাল স্বীকৃত, এইরূপ কতিপয় লক্ষণ বা আচরণ যাহা বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক অথবা উভয়ের সহিত সম্পর্কিত এবং যাহা ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বাধাগ্রস্ত করে।

২ (১৮) ধারায় বলা হয়েছে, মানসিক সুস্থতা অর্থ এমন একটা স্বাভাবিক অবস্থা যখন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের সম্ভবনাগুলো অনুধাবন করতে পারেন, জীবনের স্বাভাবিক চাপসমূহের সহিত সংগতি রাখিয়া জীবনযাপন করিতে পারেন, উৎপাদনমুখী ও ফলদায়ক কার্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখিতে পারেন এবং নিজ এলাকায় জনগোষ্ঠীর জন্য কোনোভাবে অবদান রাখিতে সক্ষম হন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ বিধিমালা-২৯৫। প্রতিবন্ধীতার ধরন ৩ এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণ কল্পে, প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইিন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধীতার ধরনগুলো হইবে যথা- ক. অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজ অডারস্ খ. শারীরিক প্রতিবন্ধীতা গ. মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা ঘ. দৃষ্টি ঙ. বাক চ. বুদ্ধি ছ. শ্রবণ জ. শ্রবণ-দৃষ্টি ঝ. সেরিব্রাল পালসি ঞ. ডাউন সিনড্রোম ট. বহুমাত্রিক ঠ. অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা।

মানসিক অসুস্থতা জনিত প্রতিবন্ধিতাণ্ডসিজোফ্রেনিয়া বা অনুরূপ ধরনের কোন মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা যেমন ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, বাই পোলার ডিজঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা বা ফোবিয়াজনিত কোন মানসিক সমস্যা যাহার কারণে কোন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন বাধাগ্রস্ত হয়, তিনি মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা ব্যক্তি বলিয়া বিবেচিত হবেন।

মানসিক স্বাস্থ্য আইন-২০১৮ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা আইন-২০১৩ দ্বারা মানসিক সক্ষমতা আইন প্রণয়নের যৌক্তিকতা পূরণ হয় না। স্মৃতি হারানো রোগ ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজের কিংবা পরিবারের কল্যাণে কাজ করতে পারে না। অনেক সময় এমন সিদ্ধান্ত নেয়, যা পরিবার এবং নিজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত প্রবীণরাই আলঝাইমার্স ও ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

ক্যান্সার, হার্ট, লিভার, কিডনি, শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘসময় ধরে চিকিৎসা গ্রহণ, ওষুধ সেবনের ফলে একটা সময়ে হাল ছেড়ে দেন কিংবা নির্জীব হয়ে পড়েন। নিজের সহায় সম্পদ থাকলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার জন্য চিকিৎসাবঞ্চিত হতে হয়। দুর্ঘটনায় পড়ে জ্ঞান হারালে, স্মৃতি নষ্ট হলে, স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন, সঞ্চয়পত্র ভাঙানো, জমিজমা সহায় সম্পদ বিক্রি করা সম্ভব হয় না। দুর্বল পরিবারগুলো চিকিৎসার জন্য টাকা-পয়সা যোগাড় করতে পারে। ডিমেনশিয়া রোগীরা টাকা-পয়সা, জমিজমা, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ কোনো ছেলেমেয়ে কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির অনুকূলে দিয়ে দেন। পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় ঠিকভাবে সই স্বাক্ষর করতে পারেন না ফলে চেকে, দলিলে সই করা নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাক্ষী, আসামি এবং বাদী হলে ন্যায়বিচার পাবার সম্ভাবনা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

মানসিক সক্ষমতা আইন প্রণয়নের ফলে যারা মানসিক অক্ষমতার কারণে নিজেরাই জীবন বা চিকিৎসা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম তাদের জন্য আইনগত কাঠামো প্রদান করবে।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত