ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ

রায়হান আহমেদ তপাদার
টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ

বাংলাদেশ আয়তনে বিশ্বের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড। এর জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বসবাসের জন্য বাড়িঘর তৈরিতে জমির চাহিদা বাড়ছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কৃষিজমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। একই কারণে জলাভূমি ভরাট, দোকানপাট নির্মাণ, হাউজিং সোসাইটি, ইটভাটাতে বনভূমি ধ্বংস করার আত্মবিনাশী প্রক্রিয়া চলছে। এখানকার মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই সামান্য। এভাবে নগরায়ণে যদি কৃষিজমি দ্রুত হারে কমে, তাহলে এই বিপুল জনসংখ্যক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। তাই এখানকার মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল।

কৃষিতে যে অবদান তা অন্য যেকোনো খাতের তুলনায় বেশি। তাই যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ১৮ কোটি মানুষের কৃষিজাত পণ্যের জোগানের বিষয়টি পরিকল্পনায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ। নানা কারণে কৃষিজমি কমে গেলে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, তা নিঃসন্দেহে আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত সবশেষ পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ পরিসংখ্যান ২০২৪ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কৃষি ও বনভূমির পরিমাণ কমে উল্লেখযোগ্য হারে নগরায়ণ বাড়ার পাশাপাশি জলাশয়ের ব্যবহার বেড়েছে। দেশের উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের ধারায় নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে কৃষিজমি ও বনভূমির পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের ধানিজমির পরিমাণ কমছে। এসব জমি কমার পেছনে মূল কারণ আমরা জমি ধ্বংস করে ঘরবাড়ি বানাচ্ছি। বন-জঙ্গল কমে গেছে, বন্যপ্রাণী চলাচলের জায়গা কমে যাচ্ছে। এটি জীববৈচিত্র্যর হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবাস ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর বেড়েছে। বর্ধিত জনসংখ্যার নানা চাহিদা পূরণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ বেড়েছে। এসব কাজের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়েছে জমির। কখনও কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে, কখনও বা বনভূমি ধ্বংস করে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, ফলে দিন দিন কৃষি ও বনভূমির পরিমাণ কমেছে। এভাবে কৃষি ও বনভূমি হ্রাস খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি। দেশের মানুষের খাদ্যের জোগানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কৃষি উৎপাদন। কৃষিজমি কমলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষিপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হবে। এমনিতেও দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন সেভাবে বাড়ছে না।

কৃষিজমি হ্রাস, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষক আয় করতে না পারাসহ নানা কারণে কৃষি উৎপাদনে নিম্নমুখীপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ধানের আবাদ হয়েছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টরে। আর সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবাদকৃত জমি ১ কোটি ১৪ লাখ হেক্টরে নেমে আসে। অর্থাৎ সর্বশেষ পাঁচ বছরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। এর বিপরীতে পাঁচ বছরে হেক্টরপ্রতি ফলন বেড়েছে শুধু ৪ শতাংশ। আর চাল উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষিজমি কমে আসা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের উদ্বেগ। অন্যদিকে বনভূমি বসবাস উপযোগী, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের জন্য যেমন জরুরি, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বনজ সম্পদের ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত বনভূমি থাকা আবশ্যক। সাধারণত পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যেকোনো দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ দেশে বনভূমি আছে ১৫ শতাংশের কিছু বেশি। যেখানে পর্যাপ্ত বনভূমি নেই সেখানে এর পরিমাণ কমে যাওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। তাছাড়া কয়েক বছর ধরে সারা দেশে গ্রীষ্মকালীন ‘হিট ওয়েভ’ প্রবাহিত হচ্ছে। জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে। তাদের চাহিদা পূরণে প্রতিনিয়ত অবকাঠামো বাড়বে। তবে সেগুলো হতে হবে পরিকল্পনা মাফিক। জীবনধারণের জন্য কৃষি ও বনভূমিও জরুরি। অনেকাংশে যেকোনো অবকাঠামোর চেয়ে এগুলো জরুরি।

তাই সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে থাকতে হবে ভূমি ও পরিবেশের সুরক্ষা। নয়তো উন্নয়নের বাই প্রডাক্ট হিসেবে জনজীবনের ঝুঁকি বাড়বে। যে ঝুঁকি বয়ে আনবে খাদ্যসংকট ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ বিপর্যয় এড়াতে হলে কৃষিজ ও বনজ ভূমির রক্ষায় মনোনিবেশ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও কৌশল গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের দিকেও নজর দিতে হবে। দেশে এখনও ভূমি ব্যবহার ও এর সুরক্ষা-সংক্রান্ত আইনের কার্যকর প্রয়োগ নেই। কৃষিজমি রক্ষায় সরকারকে সুনির্দিষ্ট আইন দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের রাশ টেনে ধরতে হবে। কৃষিজমি বাঁচিয়ে পরিকল্পিতভাবে এসব কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা দরকার। যে জমি থেকে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়, সে জমি যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। যেভাবে অলক্ষ্যে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে, তাতে সংকট দেখা দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

দেশের মানুষের খাদ্য সংস্থান যে জমি থেকে হয়, তা রক্ষায় সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাছাড়া বায়ু, পানি দূষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে মাটি দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একদিকে আবাদি জমির পরিমাণ কমে আসছে, অন্যদিকে কমছে আবাদি জমির মাটির পুষ্টিগুণ। সরকারি এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ভূমির প্রায় ৭৫ শতাংশই এখন উর্বরতা ঘাটতিতে ভুগছে। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাবারের পুষ্টিগুণ নিশ্চিতে জমির সুরক্ষার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ কমানোও অতীব জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষি ও বনভূমি সুরক্ষিত করে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে এ দেশে সবাই বিপরীত পথে হেঁটেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রকৃতিগতভাবে এ দেশকৃষি উপযোগী এবং কোনো ধরনের চাষ ছাড়াই বীজ ফেলে রাখলে গাছ জন্মে যায়। আবার অধিকাংশ জমি তিন ফসলি। যদিও অনেক তিন ফসলি কৃষিজমি বর্তমানে এক ফসলি হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উর্বর দেশ পৃথিবীতে খুব কমই রয়েছে। অথচ বছরের পর বছর ধরে তা বিবেচনাহীনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। উপরন্তু নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেও কৃষি ও বনভূমির পরিমাণ কমেছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষিজমি, অকৃষি খাতে ব্যবহারের যে বর্তমান ধারা, সেটি চলমান থাকলে ২০৭০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে আর কোনো কৃষিজমি থাকবে না। কৃষি খাত ও কৃষকের সুরক্ষায় কৃষিজমি সংরক্ষণে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। এ কথা সত্য যে, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা আর অস্থিরতার মধ্যেও দেশকে অনেকটা স্বাভাবিক রাখছে কৃষি। আর বনভূমি জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করছে। সে কারণেই কৃষিজমি ও বনভূমি সুরক্ষা জরুরি।

এসব জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দরকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও নীতিমালা। কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহারের প্রবণতা কঠোরভাবে রুখতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে নগরায়ণ হবে, শিল্পায়ন হবে; কিন্তু কৃষিজমি ও বনভূমি ধ্বংস করে নয়। তবে আশার কথা সম্প্রতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, শিগগির কৃষিজমি সুরক্ষা আইন পাস করা হবে। সেখানে কৃষিজমি ও কৃষকের সুরক্ষার কথা থাকবে। তবে আশার কথা হলো, জলাশয়ের ব্যবহার ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে যেখানে জলাশয় ছিল ১৮,১২০.০৫ বর্গকিলোমিটার, সেখানে ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৯,১৯৬.১২ বর্গকিলোমিটার। উপকূলীয় জলাশয় ও মোহনার এলাকা ৬৪.৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রের উচ্চতার কারণে এর গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জলাশয় রক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

এ ক্ষেত্রে গুল্মভূমি ও অনাবাদি ভূমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, যা প্রায় ২০ ও ২১ শতাংশ। এই পরিবর্তনগুলো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। তবে কৃত্রিম বনায়ন ও পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন পরিস্থিতি কিছুটা সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সহায়তা করছে। কৃষিভূমি, বনভূমি হ্রাসের পরিবর্তনগুলো আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। আমাদের টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় আরও সচেতন ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, যদি আমরা দায়িত্বশীল ও দূরদর্শী হই। তবে এই লক্ষ্য অর্জনে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত