ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সড়ক সংস্কার এখনই জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসুক সরকার ও জনতা

মো: শামীম মিয়া
সড়ক সংস্কার এখনই জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসুক সরকার ও জনতা

বাংলাদেশে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করেন সড়ক পথে। সড়ক পরিবহন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণরস। তবে এই প্রাণপ্রদ বাহনগুলো যখন নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পরিবহন ব্যবস্থার অবস্থা। গত জুন ২০২৫ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৬৯৬ জন, আহত হয়েছে প্রায় ১৮৬৭ জন। দৈনিক গড়ে ২৩টি দুর্ঘটনা, যার মধ্যে গড়ে ২৩ জন প্রাণ হারাচ্ছেন- এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান আমাদের সতর্ক করে দেয় অবিলম্বে সড়ক নিরাপত্তায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান : সংক্ষিপ্ত ও ভয়াবহ সত্য রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে ৬৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই দুর্ঘটনায় নিহত ৬৯৬ জনের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২২৮, পথচারী ১২০, বাসে ৬৩, ট্রাক ও পিকআপে ৫৪, থ্রি-হুইলার দুর্ঘটনায় ১৫১ এবং স্থানীয় যানবাহনে ৪৪ জন মারা গেছেন। এমনকি বাইসাইকেল ও রিকশাতেও নিহত হয়েছেন ১৪ জন। ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ২০২টি দুর্ঘটনায় ১৮৭ জন নিহত হয়েছেন। জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনার হার ৪২.৯৬% এবং সকাল ৬টা থেকে ১২টার মধ্যে দুর্ঘটনার প্রায় ২৬.২৬% সংঘটিত হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ মাত্র জুনেই প্রায় ২৪,৬৩২ কোটি টাকা। এই তথ্যগুলো দেশের নিরাপত্তাহীন পরিবহন ব্যবস্থার এক ভয়ানক চিত্র তুলে ধরে।

পরিবহন খাতের অব্যবস্থা ও তার প্রভাব : দেশের সড়ক দুর্ঘটনার এই ভয়াবহ পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অবহেলা, দুর্নীতি ও অদক্ষতা। পুরানো ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, যানজট, নিয়ম ভঙ্গ, চালকের অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং যানবাহনের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোরতার অভাব দুর্ঘটনার মূল কারণ। অগণিত মানুষ এর ফলে দৈনন্দিন জীবনে বিপদে পড়ে, পরিবার ও সমাজে শোকের ছায়া পড়ে। বিশেষ করে যাত্রীবাহী বাস ও ভারি যানবাহনের অসতর্কতা ও অনিয়ম জাতীয় মহাসড়কে প্রাণহানির শীর্ষ কারণ। অনেকে সড়ক নিরাপত্তার নিয়ম অমান্য করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালায়, হেলমেট না পরিধান করে এবং মোবাইল ফোনে কথা বলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চালিয়ে যায়। এসব চালকের অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে অমিল হয় সড়ক পরিবহন সংস্কৃতি।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব : প্রাণহানির পাশাপাশি দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজে আর্থিক দুরবস্থা সৃষ্টির শিকার হন। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে দুর্ঘটনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে, যারা চিকিৎসা ব্যয় এবং কর্মক্ষমতার ক্ষতি সহ্য করতে পারে না। দেশের অর্থনীতিতেও এই পরিস্থিতির প্রভাব পরিসংখ্যানভিত্তিক অঙ্কে লক্ষণীয়।

সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্ব : সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে যেমন ডিজিটাল ট্রাফিক মনিটরিং, সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, চালক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও কড়া আইন প্রণয়ন। তবে বাস্তবায়নে অনেক বাধা রয়েছে। দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা এবং পর্যাপ্ত মনিটোরিংয়ের অভাবে এসব পদক্ষেপ কার্যকর হচ্ছে না। আইন প্রয়োগে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নিয়মিত যানবাহন পরিদর্শন, লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া উন্নত করা এবং চালকদের মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ জরুরি। জরুরিসেবা দ্রুত পৌঁছানোর জন্য মেডিকেল ও ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

প্রযুক্তি ব্যবহার ও অবকাঠামোর উন্নয়ন : স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম, সিসিটিভি নজরদারি, ডিজিটাল টোল কালেকশন ও ইলেকট্রনিক যানবাহন নিবন্ধন ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে হবে। সড়ক ও ব্রিজ সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে যানজট কমিয়ে নিরাপত্তা বৃদ্ধি সম্ভব। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় উন্নত সড়ক নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সচেতনতা : সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি জনগণকেও সড়ক নিরাপত্তায় সচেতন হতে হবে। শিশু, তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সড়ক ব্যবহার নিয়ম শেখানো, চালকের দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা এবং আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।

আন্তর্জাতিক মডেল থেকে শেখার সুযোগ : আধুনিক উন্নত দেশগুলো যেমন জাপান, জার্মানি ও সুইডেনে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সফল হয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহার, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। বাংলাদেশও তাদের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে নিজস্ব পরিবহন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ পরিসংখ্যান আমাদের করুণ বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আর সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। নিরাপদ সড়ক, শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া দেশের মানুষ ও অর্থনীতি ধ্বংসের মুখোমুখি। সরকারের দৃঢ় নেতৃত্ব, সুশাসন, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং নাগরিক সচেতনতা মিলিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। পরিবহন খাতের সংস্কার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং মানুষের কল্যাণের ভিত্তি। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে।

লেখক : সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত