১০ জুলাই ২০২৫ তারিখ সারা দেশে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল। সরকারি সূত্র থেকে জানা যায়, এবার দেশের ৯টি সাধারণ বোর্ড এবং বিশেষায়িত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে মোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যেখানে গড় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক কম। এমনকি শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ বছর ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, যা কয়েক বছরের গড় তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরা তাদের বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য করেছেন। এসবের সারসংক্ষেপ বিশ্লেষণ করে কয়েক বছরের তুলনায় এ বছরের গড় পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি অবনতি হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা, শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি, অন্যান্যবারের চেয়ে প্রশ্নের কাঠিন্যমাত্রা বৃদ্ধি ও মূল্যায়নে অতি কড়াকড়ির প্রতিফলন, ছাত্র-জনতার বিপ্লব, শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) এর পরিবর্তন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বিমুখ হওয়া ও মনোযোগের ঘাটতি, ওভার মার্কিং ও গ্রেস মার্কিং-এ নিয়ন্ত্রণ আরোপ ইত্যাদি।
এসব কারণগুলোর সবগুলোর সম্মিলিত প্রভাব এবারের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর পড়েছে। যদিও এবারের এসএসসি সমমান পরীক্ষার ফলাফলকে বিপর্যয় হিসেবে বিভিন্ন মহল চিহ্নিত করছেন। তবে উপরের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে একে বিপর্যয় বলা ঠিক হবে না। শিক্ষার্থীরা যখন নবম শ্রেণিতে পড়ছিল, তখন নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পড়াশোনা শুরু করে। কিন্তু দশম শ্রেণিতে উঠে তারা আবার ২০১২ সালের পুরোনো কারিকুলামে ফিরে যায়। যেখানে শিক্ষার্থীরা অনেকেই পরিস্থিতির শিকার। হঠাৎ এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার বিপ্লব ও বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতার দরুন বছরের বড় একটা সময় শ্রেণিকার্যক্রম ও পড়াশোনার বাইরে সময় অতিক্রম করেছে। এমনকি শ্রেণিকক্ষে ফেরার পরেও তারা বিভিন্ন মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছে।
ফলশ্রুতিতে শিক্ষকরা চাইলেও এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারেননি। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখনও মুখস্থভিত্তিক শিক্ষার মধ্যে আটকে আছে। এর থেকে বের হয়ে আসার জন্য শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন না। কেননা, তারাও এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী নন। আবার আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও অভিভাবকরা সন্তানদের জিপিএ-৫ প্রাপ্তির যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ধাবিত করেছেন, তাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা মুখস্থভিত্তিক শিক্ষার মধ্যে আটকে আছে, যার ফলে সৃজনশীল চিন্তাধারার যে বিকাশ প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে না। এই প্রবণতার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে শুধু একজন পরীক্ষার্থী হয়ে ওঠে, শিক্ষার্থী নয়। ব্যর্থ হয় যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের যোগ্যতা অর্জনে। আমরা প্রায়শই জিপিএ-৫ প্রাপ্তি কিংবা পাসের হার হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে বলি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উঠে আসে নানা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সফলতার গল্প, সেইসঙ্গে আমরা নেতিবাচক কিছু খবরও শুনতে পাই। যেমন এসএসসি পরীক্ষায় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এবারে কেউ পাস করেনি, আবার আমরা কিছু দুঃখজনক সংবাদও শুনতে পাই যেমন পরীক্ষায় পাস কিংবা জিপিএ-৫ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। অথচ আমরা সফলতা নিয়েই পড়ে থাকি কিংবা নেতিবাচক সংবাদ মুখরোচক গল্প হিসেবেই নিয়ে থাকি; কিন্তু আমরা নেতিবাচক সংবাদের পেছনের কারণ কিংবা বিভিন্ন ব্যর্থতার খবরের পেছনের গল্পগুলো নিয়ে আমরা কারণ অনুসন্ধান করি না।
অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের সবসময়ই অসম প্রতিযোগিতার দিকে ধাবিত করতে উদ্বুদ্ধ করি, কখনোই তাদের প্রকৃত মানুষ হওয়ার দিকে ধাবিত করি না, শিক্ষকরা এখনও গতানুগতিক মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারি না। কেননা, আমরা নিজেরাই আত্মবিশ্বাসী না। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের সময় উপযোগী ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষকরা এখনও পুরোনো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পড়ান এবং শিক্ষার্থীর মনোবল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকরী পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন না। আমরা ‘জেনারেশন জি’, কিংবা ‘জেনারেশন আলফা’-এর চাহিদা উপযোগী শিক্ষাক্রম তথা শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি তাহলে আমরা তাদের কাছে কীভাবে কিছু আশা করব? এসব বিষয় থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নিয়ে ভাবা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ফেরানো জরুরি। শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাদের শ্রেণিকার্যক্রমে মনোযোগ অনেক হ্রাস পাচ্ছে। এটা অবশ্যই উদ্বেগের। অতিসম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাদের শ্রেণিকার্যক্রমে মনোযোগ অনেক হ্রাস পাচ্ছে। এটা অবশ্যই উদ্বেগের। পাশাপাশি যথোপযোগী শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন ও গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা জরুরি। শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র বই পড়ানো আর মুখস্থ করানোর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধকরণ জরুরি। আমরা আশাবাদী- আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবক সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অচিরেই এসব অবস্থা কাটিয়ে তারা সামনের দিনে আরও ভালো করবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের বোঝানো জরুরি যে, এসএসসি পরীক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পাবলিক পরীক্ষা; কিন্তু এটাই জীবনের শেষ কথা নয়, এটি শুধু সূচনাপর্ব আর শুধুমাত্র জিপিএ-৫ পাওয়াই বড় কথা নয়। বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতা অর্জন এবং ভালো মানুষ হওয়াই জরুরি যা মানুষকে সত্যিকারের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।
সহকারী অধ্যাপক
শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়