ঢাকা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনীতিতে নতুন মোড়

রাজনীতিতে নতুন মোড়

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া তরুণরা নতুন দল ঘোষণা দেয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। তরুণদের এ দল গঠিত হলে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বংলাদেশের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে দলটি।

সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে তরুণদের রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা চলছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এ দলের আত্মপ্রকাশ হতে পারে। তবে এখনো এ দলের নাম চূড়ান্ত হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেশে যখন জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হয়ে গেছে, তখন নতুন এ দলের প্রস্তুতি বাস্তবে কতটা এগিয়েছে, এই দলে কারা থাকবেন, দলের নীতি-আদর্শ কী হবে, সম্ভাব্য শীর্ষ নেতাইবা কে হবেন, সেসবের দিকে এখন দৃষ্টি সবার।

বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সংগঠনের মানুষেরও দৃষ্টি এই দলের দিকে। যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় গত প্রায় চার দশকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো সারা দেশে বিস্তৃত বড় কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও সেগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দলে রূপান্তরিত হতে পারেনি। এছাড়া বামণ্ডডান, জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ইসলামপন্থি আদর্শের রাজনীতিও আগে থেকেই উপস্থিত আছে দেশটিতে। ফলে ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে এখন সর্বত্র চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।

গণঅভ্যুত্থানে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে বেরিয়ে এসে সেটা করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সম্প্রতি গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতেই পারে। এটা তো তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সেক্ষেত্রে আমরা তাদের স্বাগত জানাব। কিন্তু একটি কথা এরই মধ্যে উঠে আসছে মিডিয়ায়। কিংস পার্টি বলে একটি কথা উঠছে। আমি মনে করি, এখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসা উচিত। অর্থাৎ সরকারের কোনো সাহায্য না নিয়ে তারা যদি দল গঠন করতে চায়, সেটা তাদের জন্যই ভালো হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার প্রস্তুতির বিষয়ে এখন পর্যন্ত কথাবার্তা হচ্ছে। আমরা দল ঘোষণা জাঁকজমকপূর্ণভাবে করতে চাই। সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাই। এই রাজনৈতিক দলে আমরা বহু নেতৃত্বের কথা ভাবছি। একক কোনো ব্যক্তিকে দীর্ঘসময় দলের শীর্ষ পদে থাকতে দেয়া হবে না। পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চাই। আমরা সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও স্বীকার করে বলেছেন, ছাত্ররা দল গঠন করবে। এ লক্ষ্যে তারা দেশজুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমকে সম্প্রতি তিনি এ কথা বলেন।

ইউনূস বলেন, একটি সম্ভাবনা হলো, ছাত্ররা নিজেরাই একটি দল গঠন করবে। শুরুতে যখন তারা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করছে, তখন আমি তিনজন ছাত্রকে আমার উপদেষ্টা পরিষদে নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, যদি তারা দেশকে ‘প্রাণ’ দিতে পারে, তাহলে তারা উপদেষ্টা পরিষদে বসতে পারে এবং প্রাণ দেয়ার জন্য কী করছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারা ভালো কাজ করছে।

এখন ছাত্ররা বলছে, কেন নিজস্ব দল গঠন করা হচ্ছে না, তাঁরা একটা সুযোগ নেবে- একথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তারা বলছে, তাঁদের (ছাত্রদের) কোনো সুযোগ নেই, এমনকি সংসদে তাঁদের একটিও আসন থাকবে না। কেন? কারণ, কেউ তাঁদের চেনে না। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস আরো বলেন, ‘আমি তাদের বললাম, পুরো জাতি তাদের চেনে। তারা যা করতে চায়, সে বিষয়ে তাদের একটা সুযোগ দিই। সুতরাং, তারা এটা করবে। এটা দরকার। কারণ, রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। অন্যত্থায় সেগুলো সেই সব ব্যক্তি নিয়ে যাবে, যারা বিগত প্রশাসন ও অন্যান্যের মতো সবকিছুর পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ খুঁজছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়তো তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এটাও একটা বিপদ। কারণ, রাজনীতি শুরু করলে সব ধরনের রাজনীতিবিদ তাদের সঙ্গে মিশে যাবে। তাই আমরা জানি না, তারা আমাদের দেশে যে রাজনীতি, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে কি না। এ ধরনের সুযোগ আছে, যা আমাদের নিতে হবে। তবে ছাত্ররা প্রস্তুত। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা দেশজুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে। এদিকে তরুণরা নতুন রাজনৈতিক দলের চেয়ে বিদ্যমান দলগুলোর সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

গত ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) প্রকাশিত ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। সারা দেশে সর্বমোট ১ হাজার ৫৭৫ জন সরাসরি ও অনলাইনে ১ হাজার ৬৬৩ জন তরুণ এ জরিপে অংশ নেন। গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসজুড়ে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, তরুণদের বড় অংশ দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সরিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের পক্ষে। সরাসরি জরিপে ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অনলাইন জরিপে ৪৪ শতাংশ তরুণ এ মত দিয়েছেন। একই সঙ্গে, দলগুলোর মধ্যে তরুণ নেতৃত্ব বাড়ানোর পক্ষে সরাসরি ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অনলাইনে ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ মতামত দিয়েছেন।

অন্যদিকে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পক্ষে সরাসরি ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অনলাইনে ২৫ শতাংশ তরুণ মত দিয়েছেন।

রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি জোরালো : জরিপের ফলাফলে তরুণদের মাঝে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অন্তত ১ থেকে ৩ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষে সরাসরি ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অনলাইনে ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ মত দিয়েছেন। তবে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে কী না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন সরাসরি ২০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অনলাইনে ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ।

ভোটের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে : আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়ার বিষয়ে তরুণদের আগ্রহ বেড়েছে। ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী তরুণদের মধ্যে ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ (সরাসরি জরিপ) এবং ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ (অনলাইন জরিপ) ভোট দেওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন।

নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ : জরিপে অংশ নেওয়া ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ (সরাসরি) এবং ৭০ শতাংশ তরুণ (অনলাইন) মনে করেন, বর্তমান বাংলাদেশে নারী ও মেয়েরা নিরাপদবোধ করছেন না। বিওয়াইএলসির নির্বাহী পরিচালক তাহসিনা আহমেদ বলেন, ‘এই সমীক্ষা দেখিয়েছে যে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুবসমাজ সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তারা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অবসান চায় এবং নাগরিকদের, বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানায়। তরুণরা মুক্তভাবে কথা বলার পরিবেশ এবং দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ চায়। তিনি আরও বলেন, তরুণরা মনে করে, সংস্কার কার্যকর করতে সরকারকে সময় দিতে হবে এবং তারা রাষ্ট্র সংস্কারে একসঙ্গে কাজ করতে চায়। যদিও কিছু তরুণ নতুন রাজনৈতিক দল চায়, বেশিরভাগই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা চায় রাজনীতিতে ভালো মানুষ প্রার্থী হোক।

তরুণদের প্রত্যাশা স্পষ্ট : জরিপের বিষয়ে তরুণ নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনায় থাকা নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, যারা বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার চান, তারা স্পষ্টভাবেই একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামো দেখতে চান। অর্থাৎ, সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর যে নতুন চেহারা দাঁড়াবে, তরুণরা সেটাই প্রত্যাশা করে।

তিনি বলেন, তরুণরা পরিবর্তন চায়। বর্তমান সরকারের অনেক দুর্বলতা থাকলেও সাধারণ মানুষ ও তরুণরা এখনও সময় দিচ্ছে, কারণ তারা বিশ্বাস করে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট। এত সংগ্রাম ও রক্তদানের পর তরুণরা পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরতে চায় না। তারা অন্তত কিছু মৌলিক পরিবর্তন চায়।

নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তরুণদের আগ্রহের কথা জানিয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, আমাদের নিজস্ব জরিপে দেখা গেছে, তরুণরা সত্যিকার অর্থেই নতুন রাজনৈতিক দল চায়। তবে তারা পুরোনো রাজনীতির দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও স্বার্থপরতার সংস্কৃতি চান না। তারা এমন একটি দল চান, যা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, দুর্নীতি মুক্ত থাকবে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবে।’ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড সফর করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফরে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রধান বৈদেশিকবিষয়ক আলোচক গিডিয়ন র‌্যাচম্যানের পডকাস্টে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ‘র‌্যাচম্যান রিভিউ’ নামের ওই পডকাস্টে তিনি আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে রাজনীতির ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত একাধিক ইস্যুতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও অ্যাক্টিভিস্ট মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক আহসান বলেন, বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তার ফলে একটা নতুন রাজনৈতিক শক্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এটি হলে দেশের তৃতীয় শক্তি হিসেবে তরুণরা এগিয়ে থাকবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন নতুন ভোটার বা ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটার প্রায় ৩২ শতাংশ। এ ভোটাররা গত ১৬ বছরে কোনো ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। নতুন রাজনৈতিক শক্তি যদি এ ভোটারদের আকর্ষণ করতে পারে, তবে তারুণ্যের বিকল্প শক্তি তৈরি হওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত