ধর্ষণের ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, সিলেট ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত সময়ে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর দেখতে চেয়েছেন। ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়া হলে, রাজপথে বিক্ষোভে নামার ঘোষণা দেন তারা। ধর্ষণের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পাশাপাশি টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার, ফেনী, গাইবান্ধা ও নরসিংদীতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ-মিছিল করেন।
গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ-মিছিল করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভে স্লোগান ওঠে, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, ধর্ষকের ফাঁসি চাই’, ‘আমার সোনার বাংলায়, ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’, ‘ধর্ষকদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’। শিক্ষার্থীরা মুখে ও কপালে লাল কাপড় বেঁধে বিক্ষোভ করেন। ‘সারা বাংলায় খবর দে, ধর্ষকদের কবর দে’, ‘আমার মাটি আমার মা, ধর্ষকদের হবে না’, এ রকম নানা দাবি লেখা ছিল শিক্ষার্থীদের পোস্টারে; কণ্ঠেও একই স্লোগান। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় বাংলার সামনে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা প্রমুখ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রসায়ন, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। তারা নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ধর্ষকের ফাঁসি দাবি করেছেন। দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনায় বিচারের দাবিতে গতকাল দিনব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু দণ্ড কার্যকর ও নারী নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে কয়েক দফায় ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এ প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল বলেন, দেশের কোথাও নারীরা আসলে নিরাপত্তা পাচ্ছে না, এমনকি শিশুরাও ছাড় পাচ্ছে না। ফলে ধর্ষণকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে। মূলত বিচারহীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এদিন ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ‘ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ’ এর কমিটি ঘোষণা করে বিক্ষোভ করেছে আন্দোলনকারীরা। সৈয়দা মেহের আফরোজ শাঁওলিকে মুখপাত্র এবং ফাহমিদা ফাইজা ও মালিহা নামলাহসহ মুখপাত্র করে ষোল সদস্যের এ কমিটি ঘোষণা করেছে প্ল্যাটফর্মটি। এসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, নতুন যে বাংলাদেশ আমরা গড়ার স্বপ্ন দেখছি সেখানে ধর্ষকের কোন ঠাঁই নাই। আমরা দেখেছি ফ্যাসিস্ট হাসিনা গত পনেরো বছরে দেশজুড়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে। ধর্ষকরা এই সংস্কৃতির সুযোগ নিয়েছে বারবার, নির্যাতিত হয়েছে আমাদের মা-বোনেরা। অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর বিচার নিশ্চিত না করলে আমরা হাসিনার মতো ইউনূসেরও বিরুদ্ধে রাজপথে দাঁড়াতে পিছপা হবো না। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়। গত শনিবার গভীর রাতে ছাত্রী হলের তালা ভেঙে ধর্ষণে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, রাত দুইটা থেকে ছাত্রীরা হলে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর রাত তিনটার দিকে প্রথম ছাত্রীহল, বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হল ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা হলের তালা ভেঙে বের হয়ে আসেন। ছাত্ররাও মিছিল নিয়ে গিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তী সময় হলপাড়া থেকে গোলচত্বর হয়ে বিক্ষোভ মিছিলটি মুক্তমঞ্চে এসে শেষ হয়। সেখানে শিক্ষার্থীরা একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এতে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। সমাবেশ থেকে গতকাল রোববার বেলা দুইটায় আবারও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ধর্ষণের প্রতিবাদ ও ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ধর্ষকদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘেষাণা দেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ‘এই দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের মা-বোনদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা বলে দিতে চাই, আপনারা যদি আমার বোনদের ও জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারেন, তাহলে এই দেশের শাসনভার চালানোর অধিকার আপনারা হারিয়ে ফেলেছেন।’ শিক্ষার্থীরা জানান, সাম্প্রতিক দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেখতে চান তারা। বিশেষ করে মাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন তারা। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় দেশব্যাপী ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও বিচারহীনতার প্রতিবাদে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পাবিপ্রবি) একই কর্মসূচি করা হয়।