ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসরায়েলে বহু সামরিক স্থাপনা ধ্বংস

* প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সব স্তর ভেদ করেছে ইরানি হাইপারসনিক মিসাইল * প্রথমবারের মতো ফাত্তাহ-ওয়ান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার * ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত * প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত * জেরুজালেম, হাইফা ও তেলআবিবে আঘাত * হায়দারের নামে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা খামেনির * চার শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান, জানাল নেতানিয়াহুর দপ্তর * ইসরায়েলকে হামলা বন্ধের আহ্বান রাশিয়ার * ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করবেন ট্রাম্প! * ট্রাম্পের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মার্কিন আইনপ্রণেতারা * ৬০ শতাংশ মার্কিন সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার বিপক্ষে * ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ * ইরানের ভেতরে ‘শত্রুপক্ষের’ ড্রোন তৈরির কারখানা শনাক্ত
ইসরায়েলে বহু সামরিক স্থাপনা ধ্বংস

টানা ষষ্ঠ দিনের মতো ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে ইরান। অপারেশন ট্রু প্রোমিজ থ্রির আওতায় মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাত এবং গতকাল বুধবার ভোরে সবচেয়ে তীব্রতার সঙ্গে ইরান হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে প্রেসটিভি। এতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সব স্তর ভেদ করে ইসরায়েলের বিভিন্ন সংবেদনশীল স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। ইরানি সময় রাত দেড়টায় হামলা শুরু হয়। মিডিয়ার ওপর ইসরায়েলি সরকারের কঠোর সেন্সরশিপের পরও সামাজিকমাধ্যমে অসংখ্য ভিডিও প্রচারিত হয়েছে, যেখানে গভীর রাতে ইসরায়েলের তিন স্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দূরপাল্লার উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তেলআবিব এবং হাইফার আকাশে বারবার আলোর তীব্র ঝলকানি দেখা গেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে, যেগুলো নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। আক্রান্ত স্থানগুলোর মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনাও রয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো। সামাজিকমাধ্যমে প্রচারিত ছবিতে বিভিন্ন সংবেদনশীল ও কৌশলগত সামরিক গোয়েন্দা স্থাপনায় ধোঁয়া ও আগুনের কুণ্ডলী উড়তে দেখা গেছে। কিছু ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম বলেছে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা তথাকথিত হোম কমান্ডের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, কারণ তারা ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়ার জন্য সময়মতো সাইরেন পাননি। একটি ইসরায়েলি টেলিগ্রাম চ্যানেল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানার ভিডিও শেয়ার করে লিখেছে, ‘ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছোড়া ইন্টারসেপ্টরের সংখ্যা দেখুন এবং গণনা করুন; ভিডিওর শেষে আপনি দেখতে পাবেন, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সব ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে লক্ষ্যবস্তুতে বারবার আঘাত হেনেছে।’ খবরে বলা হয়, গতকাল বুধবার ফজরের নামাজের সময় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অধিকৃত পশ্চিমতীরের আকাশের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। তেলআবিব ও হাইফার দিকে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের যাত্রা দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েন ফিলিস্তিনি মুসল্লিরা। ইসরায়েলি সংবাদপত্র ইয়েদিওথ আহরোনোথ এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ইরানি হামলার সর্বশেষ ধরন ছিল অস্বাভাবিক। বিস্ফোরণে শব্দ ছিল বিকট; আগের হামলাগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা।

প্রথমবারের মতো ফাত্তাহ-ওয়ান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার : ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি বলছে, তারা মঙ্গলবার দিবাগত রাতে এবং গতকাল বুধবার ভোরে অভিযানের একাদশ স্তরে ইসরায়েলের দিকে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র ফাত্তাহ-ওয়ান নিক্ষেপ করেছেন। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর ইরান যখন ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল, তখনও তারা বেশ কয়েকটি ফাত্তাহ-ওয়ান ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিলেন। তবে চলমান সংঘাতে ইরান সম্ভবত এই প্রথম ফাত্তাহ-ওয়ান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করল। ২০২৩ সালে ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করে ইরান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ক্ষেপণাস্ত্রটির নামকরণ করেন। আইআরজিসি এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘ইসরায়েল বিধ্বংসী’ বলে উল্লেখ করেছে। এটি উন্মোচনের সময় ইরানের রাজধানী তেহরানে একটি বিশাল ব্যানার টাঙানো হয়েছিল, যেখানে হিব্রু ভাষায় লেখা ছিল- ‘৪০০ সেকেন্ডে তেলআবিবে।’ অতি উচ্চগতির হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি লক্ষ্যবস্তুতে এমন গতিতে আঘাত হানতে পারে যে, বর্তমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা প্রতিহত করতে পারে না। এমনকি সাড়া দেওয়ার আগেই তা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র মাঝপথে দিকও পরিবর্তন করতে পারে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ-ও জানিয়েছে, তারা ইরান থেকে ছোড়া নতুন ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তারা বলেন, হুমকি প্রতিহত করতে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে। ইসরায়েলি নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আইআরজিসি জানিয়েছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলাগুলো বিশেষভাবে ইসরায়েলের সেসব বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে, যেখান থেকে ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালানো হয়েছিল। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আমাদের হামলা নিরবচ্ছিন্ন, জটিল, বহুস্তরবিশিষ্ট এবং ধাপে ধাপে চলতে থাকবে। আমরা সেই বিমানঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করেছি, যেখান থেকে ইহুদিরা ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছিল।’ এর আগে ইরানের সরকারি সংবাদ সংস্থা ইরনা জানিয়েছিল, ইরান মঙ্গলবার দশম ধাপে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শুরু করেছে।

ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করল ইরান : তেহরান টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ইরানের রাজধানীর কাছে ভূপাতিত করা হয়েছে। রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ইরানের ভারামিন শহরের গভর্নর হোসেইন আব্বাসি গতকাল বুধবার সকালে এই তথ্য জানিয়েছেন। ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, গভর্নর হোসেইন আব্বাসি বলেছেন, দেশটির সেনাবাহিনীর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইসরায়েলের এই সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমানটি ভূপাতিত করে। গত শুক্রবার ভোরে ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হয়। এরপর থেকে এ নিয়ে ইসরায়েলের মোট পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইরান। এফ-৩৫ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান। এটি রাডারে সহজে ধরা পড়ে না। এর একাধিক সংস্করণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এটি ব্যবহার করে।

প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত করল ইরান : প্রথমবারের মতো সফলভাবে ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে তেহরান। গতকাল বুধবার সকালে ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইসফাহানে এই ঘটনা ঘটে বলে দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে। ভূপাতিত ড্রোনটি হার্মিস ৯০০ সিরিজের বলে দাবি করা হচ্ছে, যা ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী ও বিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্রগুলোর একটি। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি আইআরআইবি এই ড্রোন ভূপাতিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এবং নজরদারির জন্য ব্যবহৃত বিধ্বস্ত ড্রোনটির ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেছে। এই ড্রোনগুলো ইসরায়েলের নিজস্ব যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী সংস্থা এলবিট সিস্টেমস হার্মিস তৈরি করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এরইমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত ড্রোনটির ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে, ড্রোনটি পতিত হয়েছে ইসফাহানের জনমানবহীন অঞ্চলে। যদিও ইসরায়েলের মতো ইরানের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, তবে রাশিয়ার সরবরাহকৃত রাডার ঘাদির এবং ফালাক-এর সাহায্যে তারা এই ড্রোনটি শনাক্ত ও ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে।

জেরুজালেম, হাইফা ও তেলআবিব সরাসরি আঘাত : আলজাজিরা জানিয়েছে, মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তেলআবিবসহ গোটা ইসরায়েলে সতর্কতা সাইরেন বেজে ওঠে। গতকাল বুধবার সকালেও ইসরায়েলের আকাশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে পেয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। খবরে বলা হয়, এর মধ্যে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা ধ্বংসাবশেষ সরাসরি জেরুজালেম, হাইফা ও বৃহত্তর তেলআবিব অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। ইরানের হামলায় ইসরায়েলের একটি পার্কিং লটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে অন্তত ২০টি গাড়ি পুড়ে গেছে। অন্যদিকে ইসরায়েলও তেহরানে পাল্টা হামলার কথা জানিয়েছে। এমন সময় এই হামলা-পাল্টাহামলা হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ইরানের আকাশের ওপর এখন আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন তিনি।

হায়দারের নামে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা খামেনির : মার্কিন প্রেসিডেন্টের কয়েকবার হুমকির পর মুখ খুলেছেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি বলেছেন, ‘মর্যাদাবান হায়দারের নামে যুদ্ধ শুরু হলো।’ সামাজিকমাধ্যমে মঙ্গলবার রাতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এই বার্তা দেন। আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি দেওয়ার পর প্রথমবারের মতো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। ‘হায়দার’ হচ্ছে ইসলামের চতুর্থ খলিফা এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাতো ভাই হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর আরেক নাম। ট্রাম্পের হুমকির পরও আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পুনর্ব্যক্ত করেন, ইরান ইসরায়েলি হামলার কঠোর প্রতিশোধ নেবে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এক্সে ইংরেজিতে লেখেন, সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর জবাব দিতে হবে। আমরা ইহুদিবাদীদের প্রতি কোনো দয়া দেখাব না। এর আগে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দিকে ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিকমাধ্যমে এক পোস্টে লেখেন, ‘আমরা সঠিকভাবে জানি, তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি সহজ লক্ষ্যবস্তু, কিন্তু নিরাপদ; আমরা তাকে বের করে আনব না, অন্তত এখনই নয়। কিন্তু আমরা চাই না, বেসামরিক নাগরিক বা আমেরিকান সেনাদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ হোক। আমাদের ধৈর্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।’ এরও কিছুক্ষণ আগে দেওয়া আরেক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, ‘ইরানের আকাশসীমা আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’ এই পোস্ট দুটির পরপরই তৃতীয় আরেকটি পোস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার বা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।’ কিন্তু, যুদ্ধ দৃঢ়ভাবে অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা।

এদিকে, গতকাল বুধবার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেন, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেবে ইরান। দেশটি দৃঢ় থাকবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শান্তির বিরুদ্ধেও। তিনি আরও বলেন, ইরান কারও কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে খামেনি এ কথা বলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের কথাও উল্লেখ করে বলেন, যারা ইরান ও এর ইতিহাস জানে তারা জানে, ইরানিরা হুমকির ভাষার প্রতি ভালো সাড়া দেয় না। আর আমেরিকানদের জানা উচিত যে, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে অপ্রতিরোধ্য পরিণতি বয়ে আনবে।

৪ শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান, জানাল নেতানিয়াহুর দপ্তর : ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে গত শুক্রবার থেকে সংঘাত চলছে। পাল্টাপাল্টি হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের দিকে ৪০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তেহরান। এ ছাড়া ইসরায়েলে হামলার জন্য তেহরান কয়েকশ’ ড্রোন পাঠিয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর গতকাল বুধবার এসব তথ্য জানিয়েছে। নেতানিয়াহুর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ইরানি হামলায় ইসরায়েলে এখন পর্যন্ত ২৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮০০ জনের বেশি। ইরানের হামলার জেরে ৩ হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর।

ইসরায়েলকে হামলা বন্ধের আহ্বান রাশিয়ার : রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ইসরায়েলকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ‘অবৈধ হামলা’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বর্তমান সংকটাপন্ন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক শত্রুতার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেছে দেশটি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ইসরায়েলের ধারাবাহিক ও তীব্র হামলা আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। এসব হামলা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করছে এবং বিশ্বকে এমন এক পারমাণবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার প্রভাব ইসরায়েলসহ পুরো বিশ্বেই পড়বে।’ রাশিয়া আরও বলেছে, ‘আমরা ইসরায়েলি নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, অবিলম্বে আইএইএ-র তত্ত্বাবধানে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা বন্ধ করুন।’ বিবৃতিতে কিছু পশ্চিমা দেশ ‘সুযোগসন্ধানী আচরণ’ করছে বলে অভিযোগ করা হয়। তবে নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করবেন ট্রাম্প : ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর কথা ভাবছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিবিসির যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অংশীদার সিবিএস নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফোরদোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোও হামলার লক্ষ্য হতে পারে বলে জানিয়েছে বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। সূত্রগুলো বলছে, এই বিষয় নিয়ে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা এ ব্যাপারে এখনও পূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। এক সিনিয়র মার্কিন কূটনীতিক সম্প্রতি টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে জানিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার বিষয়টি ‘বিবেচনায় রয়েছে’, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। ওই কর্মকর্তা বলেন, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে সিদ্ধান্তটা আমাদের নয়, হোয়াইট হাউস নেবে।

ট্রাম্পের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মার্কিন আইনপ্রণেতারা : মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা তুঙ্গে উঠতে থাকায় মার্কিন আইনপ্রণেতারা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এর পেছনে মূল লক্ষ্য- একটি বিস্তৃত যুদ্ধ এড়ানো। এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে এবং আগে থেকেই মোতায়েন কিছু বিমান বহরের মিশন বাড়াচ্ছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের একজন জানিয়েছেন, নতুন করে মোতায়েনের মধ্যে রয়েছে এফ-সিক্সটিন, এফ-টোয়েন্টি-টু ও এফ-থার্টিফাইভ যুদ্ধবিমান। এই প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসের দুই দল থেকেই বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা ট্রাম্পের যুদ্ধক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ক্যানটাকির রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান থমাস ম্যাসি প্রতিনিধি পরিষদে একটি বিল উত্থাপন করেছেন, যাতে বলা হয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে চাইলে ট্রাম্পকে অবশ্যই কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হবে। এদিকে সিনেটেও একই ধরনের একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাট সিনেটর টিম কেইন। তিনি বলেছেন, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একমাত্র তখনই যুদ্ধ গ্রহণযোগ্য, যখন সেটি যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করতে অপরিহার্য হয়। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স আরও একধাপ এগিয়ে অভিযোগ করেছেন, ‘ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে ইরানে হামলা চালিয়েছে, যাতে করে চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বিশেষ করে পারমাণবিক সংলাপ বিকল হয়ে যায়। সিনেটর র‍্যান্ড পলও সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে বলেন, ‘এই যুদ্ধে জড়ানো আমাদের দায়িত্ব নয়’। কংগ্রেসম্যান ম্যাসিও এক্স-এ লিখেছেন, ‘এটা আমাদের যুদ্ধ নয়’। কংগ্রেসওম্যান ইলহান ওমর এক্স-এ লিখেছেন, ‘কেউ আমেরিকানদের ওপর আক্রমণ করছে না বা করেনি। এখন সময় এসেছে আমেরিকানদের এই যুদ্ধে টেনে আনা বন্ধ করার।’

৬০ শতাংশ মার্কিন সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার বিপক্ষে : এরপরও ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানে হামলা চালাতে পারে। তবে প্রায় ৬০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জড়িয়ে পড়ার বিপক্ষে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউগভের এক জরিপে মার্কিন নাগরিকদের এমন অবস্থানের কথা উঠে এসেছে। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, মাত্র ১৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, তারা ইরানে মার্কিন বাহিনীর হামলার পক্ষে। আর ২৪ শতাংশ বলেছেন, তারা এখনও বিষয়টি নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেক মার্কিনির মতে, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু। আর ২৫ শতাংশ বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক ‘অবন্ধুসুলভ’।

ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ : ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জেরুজালেমে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বুধবার থেকে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত তিনদিন বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে দেশটির রাজধানী তেলআবিবে মার্কিন দূতাবাসের কনস্যুলার সেবাও এ সময়ে বন্ধ রাখা হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত চলমান থাকার পরিপ্রেক্ষিতে তিন দিনের জন্য দূতাবাস বন্ধ রাখার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে দূতাবাসের কর্মীদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। মার্কিন দূতাবাস আরও জানিয়েছে, ইসরায়েল ছেড়ে যেতে ‘বেসরকারি মার্কিন নাগরিকদের’ সহায়তা করার বিষয়ে এ মুহূর্তে তাদের কোনো ঘোষণা নেই। দূতাবাসের বিবৃতি অনুযায়ী, ইসরায়েলের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলো এখন বন্ধ আছে।

ইরানের ভেতরে ‘শত্রুপক্ষের’ ড্রোন তৈরির কারখানা শনাক্ত : ইরানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রদেশে ‘শত্রুপক্ষের’ ড্রোন তৈরির কারখানা এবং ড্রোন বহনকারী যানবাহন শনাক্তের কথা নিশ্চিত করেছেন দেশটির পুলিশের মুখপাত্র সাঈদ মন্তাজেরোলমাহদি। পুলিশের এই মুখপাত্রের বরাতে খবরটি প্রকাশ করেছে ইরানের লেবার নিউজ এজেন্সি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসরায়েলের ১৪টি ড্রোন ভূপাতিত করার কথা জানিয়েছে ইরানের পুলিশ।

ইরানে এ পর্যন্ত নিহত ৫৮৫ : যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক অধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস বলছে, ইরানজুড়ে ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৮৫ জন নিহত নিহত হয়েছেন। আহত ১ হাজার ৩২৬ জন। সংগঠনটি বলেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৩৯ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ১২৬ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে তারা শনাক্ত করতে পেরেছে। ইসরায়েলি হামলায় হতাহতের বিষয়ে সর্বশেষ গত সোমবার তথ্য জানিয়েছে ইরান সরকার। দেশটির সরকারি হিসাবে, নিহতের সংখ্যা ২২৪। আর আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৭৭ জন মানুষ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত