ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঢালাও মামলার পেছনে বাণিজ্য

ঢালাও মামলার পেছনে বাণিজ্য

ঢালাওভাবে মামলা ও আসামি করার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় কিংবা মামলা থেকে নাম খারিজ করে দেওয়ার নামে বাণিজ্যের অভিযোগ দিনে দিনে বাড়ছে। এতে বহু মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের পর প্রায় ১৪ হাজার বিভিন্ন রকম মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৫৯৯টি আর অন্যান্য মামলা ৯০০টি। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা না নেওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় বিরোধের জেরেও কোনো কোনো ব্যক্তিকে অন্য অনেকের সঙ্গে মামলায় আসামি করার অভিযোগ আছে। জুলাই বিপ্লবের পর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ গণপূর্ত অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলার তালিকা থেকে নাম সরিয়ে দেওয়ার কথা বলে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। তবে গণপূর্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ষড়যন্ত্র করে কিছু ঠিকাদার প্রকৌশলীদের আসামি করেছেন। কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য, মামলার আসামিদের বিভিন্ন চাপে রেখে ঠিকাদারি কাজ ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করার চেষ্টা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা এখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ মামলায় গ্রেপ্তারের ভয়ভীতি দেখান। টাকা দিলেই মামলা থেকে রেহাই পাব, এমনও কেউ কেউ বলছেন।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাশাপাশি এভাবে থানায় অভিযোগ দায়ের করে আর্থিক সুবিধা আদায় করে কিছু কুচক্রি মহল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলার জটে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। শুধু সরকার নয়, আইনজ্ঞরাও এ ধরনের মামলাগুলোর ব্যাপারে তীব্র সমালোচনা করেছেন। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ড. সারা হোসেন বলেছেন, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা করে আসল মামলাগুলোকে গুরুত্বহীন করা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ভিত্তিহীন মামলা জুলাই বিপ্লবের চেতনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মামলা বাণিজ্যের উৎসব চলছে দেশজুড়ে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এ ধরনের মামলাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি।’ কিন্তু এসব মামলায় হয়রানি, সম্মানহানি চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

জানা গেছে, মানিকগঞ্জে মামলার নামে চাঁদাবাজি ও পুলিশের সঙ্গে অসদাচরণসহ অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই প্রতিনিধিকে আটক করে পুলিশ। আটকৃত আশরাফুল ইসলাম রাজু ও মেহেরাব খান। এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক ওমর ফারুক বলেন, রাজু ও মেহেরাবকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেন। শুনেছি তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। তবে তারা দুজনই কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। আটকদের বিষয়ে মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি এসএম আমান উল্লাহ বলেছিলেন, মেহেরাব ও রাজু আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে মমলা দায়ের করেন। আবার সেই মমলা থেকে আসামিদের নাম উঠিয়ে দিবে এমন কথা বলে তাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা চাঁদা দাবি করেন।

পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এলাকায় চাঁদাবাজি, পূর্ব শত্রুতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বানোয়াট মামলা করা হয়। এসব বানোয়াট মামলার পেছনে জমি দখলের ইস্যুও থাকছে। আর ‘মামলা বাণিজ্য’ করতে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সরকারি কর্মকর্তাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। আবার অনেক মামলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাদী যেমন আসামিকে চেনেন না, আসামিও বাদীকে চেনেন না। কোনো কোনো মামলায় বাদী হিসেবে নিজের নাম দেখে বাদী নিজেই চমকে উঠছেন।

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ডিএমপি সদরদপ্তরে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) কার্যনির্বাহী কমিটির সঙ্গে মতবিনিময়কালে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, সরকার বদলের প্রেক্ষাপটে করা মামলায় অনেক বাদী ‘ঢালাওভাবে ইচ্ছেমত’ আসামির নাম দিয়ে ‘চাঁদাবাজি’ করেন। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে মামলা নিতে ‘বাধ্য করা হয়েছে’ স্বীকার করে সেসব ‘গণ-মামলায়’ কারো নাম থাকলেই অযথা হয়রানি না করার কথাও বলেন তিনি। ডিএমপি কমিশনার বলেন, অনেক বাদী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা করেছেন পরিকল্পিতভাবে ‘বাণিজ্য করতে’। এজন্য ১৫০-২০০ বা আরও বেশি আসামি করা হয়েছে। প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা বা বিগত সরকারের শীর্ষ নেতাদের নাম দিয়ে পরে ঢালাওভাবে ইচ্ছেমত নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশকে মামলা নিতে বাধ্য করা হয়েছে। মামলা এবং ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্যে’ কিছু পুলিশ সদস্য জড়িত বলেও স্বীকার করেন সাজ্জাত আলী।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের কয়েকজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন, রামপুরা ও সাভার থানায় মামলা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে কতিপয় অসাধু আইনজীবী, পুলিশ সদস্য ও দালাল চক্র জড়িত। কোথাও প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো এবং কোথাও চাঁদাবাজির জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা করা হয়েছে। ঢালাও আসামি করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত জারি করতে হয়। গত বছরের ১৪ অক্টোবর জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চাঁদাবাজি, ব্ল?্যাকমেল করাসহ নানা রকম হয়রানি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। এ ধরনের মামলা করার মাধ্যমে যারা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত