ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইরানে মার্কিন হামলা, কঠোর জবাব তেহরানের

* মার্কিন জাহাজে হামলা ও হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি * ৪০ হাজার মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানবে ইরান * পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ হবে না, জানাল তেহরান * যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, শুরু হলো, হুথির হুঁশিয়ারি * মার্কিন হামলা বিপজ্জনক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ : জাতিসংঘ * ‘অসাধারণ সামরিক সাফল্য’ বললেন ট্রাম্প, অভিনন্দন নেতানিয়াহুর * হামলার সমালোচনা মার্কিন আইনপ্রণেতাদের * ইরান পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকে আইএইএ * মার্কিন হামলায় গভীর উদ্বেগ সৌদি আরবের
ইরানে মার্কিন হামলা, কঠোর জবাব তেহরানের

ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বয় করে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থাপনাগুলো হলো- ফোরদো, নাতান্জ ও ইসফাহান। তবে হামলার আগেই স্থাপনাগুলো খালি করা হয়েছিল। ইরানের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বরাতে সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা বলছে, আদতে সেখানে তেজষ্ক্রিয়তা সৃষ্টি করার মতো কোনো পদার্থ নেই। ওই কর্মকর্তার মন্তব্য থেকে ধারণা করা হচ্ছে, বোমা হামলার আগেই হয়তো স্থাপনাগুলো থেকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বা তেজষ্ক্রিয় উপাদান সরিয়ে নিয়েছিল ইরান। দেশটির ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার সেফটি সিস্টেম সেন্টার বলেছে, ক্ষয়ক্ষতি একেবারে সামান্য; মার্কিন হামলার কারণে কোনো তেজষ্ক্রিয়তা সৃষ্টি হয়নি। সংস্থাটি নিশ্চিত করেছে, সব ধরনের ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে এবং পরিস্থিতি ইরানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেন্টারের বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়, ঘটনাস্থলের আশপাশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের জন্য কোনো বিপদ নেই; তারা স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন।

এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শনিবার দিবাগত রাতে ইরানের যে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমানগুলো হামলা চালিয়েছে, তার একটি ফোরদো। সেখানে ছয়টি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান উড়ে গিয়ে মোট ১২টি ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা ফেলেছে। মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে ৩০ ‘টিএলএএম’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে ইরানের নাতাঞ্জ আর ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায়। সেইসঙ্গে একটি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান নাতাঞ্জে উড়ে গিয়ে দুটি বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলেছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

কঠোর জবাব দিচ্ছে ইরান : মার্কিন হামলার জবাবে গতকাল রোববার সকালে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করেছে ইরান। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, সকালে ইরান থেকে একঝাঁক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ১০ জায়গায় আঘাত হেনেছে। পরিষেবার মুখপাত্র জানিয়েছেন, কারমেল, হাইফা, তেলআবিব ও উত্তর উপকূলীয় সমভূমিতে এসব হামলা হয়। হামলায় ১১ জন গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানান তারা। আরও অনেক ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের পথে রয়েছে বলে এ সময় জানায় ইসরায়েল। আলজাজিরা বলেছে, মার্কিন হামলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ও উত্তর ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় সাইরেন বেজে ওঠে। এরপর ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বেসামরিক নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জরুরি নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে শনিবার দিবাগত মধ্যরাতের কিছুক্ষণ পর গোলান মালভূমির ইসরায়েলি স্থাপনাগুলোতে ইরানের ড্রোন হামলা হয়।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, গতকাল ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে সাহায্যকারী ঘাঁটি, কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার এবং একটি জৈব গবেষণা কেন্দ্র। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বরাতে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত্ব টেলিভিশন জানায়, দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে এসব হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের সর্বশেষ এ হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ৮৬ জন আহত হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। দৈনিক ইসরায়েল হাইয়োমণ্ডএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান অন্তত ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। যেগুলো হাইফা, তেলআবিব ও ইসরাইলের উপকূল ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হেনেছে।

ইসরায়েলের আকাশসীমা বন্ধ : উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ইরানের পাল্টা হামলার ভয়ে আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। মার্কিন বোমা হামলার পরপর এমন পদক্ষেপ নেয় তেল আবিব। ইসরায়েলি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কারণে’ তারা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের আকাশসীমা প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য বন্ধ রেখেছে। তবে মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে স্থল ক্রসিং পয়েন্টগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, ইরানের পাল্টা হামলার আশঙ্কায় বড় জমায়েত, জনগণের চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জমায়েত, কর্মক্ষেত্রে, গুরুত্বপূর্ণ ভবনে এসব বিধিনিষেধ থাকবে। এক বিবৃতিতে আইডিএফ এসব বিধিনিষেধের কথা জানিয়েছে।

আলি খামেনির হুঁশিয়ারি : মার্কিন হামলার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে গত বুধবার টেলিভিশনে দেওয়া তার এক বক্তব্য আবারও শেয়ার করা হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জড়ায়, তাহলে তা হবে তাদের নিজেদের ক্ষতির জন্য। ওই ভিডিও বার্তায় খামেনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে ক্ষতির মুখে পড়বে, তা ইরানের যে কোনো ক্ষতির চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে।’ এদিকে, মার্কিন হামলার পরিণতি ‘চিরস্থায়ী’ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি। সেইসঙ্গে তিনি ওয়াশিংটনকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তিন পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো মার্কিন হামলার পর এই প্রথম প্রকাশ্যে মন্তব্য করলেন ইরানের কোনো উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে আরাকচি বলেন, ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা করে জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং এনপিটির গুরুতর লঙ্ঘন করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আজ সকালের ঘটনাগুলো অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর চিরস্থায়ী পরিণতি হবে। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যকে অত্যন্ত বিপজ্জনক, আইনবহির্ভূত ও অপরাধমূলক আচরণের জন্য সতর্ক থাকতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইরান তার সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ ও জনগণকে রক্ষার সব অধিকার রাখে।’

মার্কিন জাহাজে হামলা ও হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টা মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ প্রণালি বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রধান রুটগুলোর একটি। ইরানের কায়হান পত্রিকাকে হোসেইন শরিয়তমাদানি সতর্ক করে বলেছেন, ‘পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এখন আমাদের পালা।’ হোসেইন শরিয়তমাদানি ইরানের রক্ষণশীল কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। সামাজিকমাধ্যম টেলিগ্রামে কায়হানের এক বার্তায় তার বরাতে বলা হয়েছে, ‘কোনো সংশয় বা বিলম্ব না করে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা অবশ্যই বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাব এবং একযোগে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের জাহাজ চলাচলের জন্য হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

৪০ হাজার মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানবে ইরান : মার্কিন হামলার পর ইরানের প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন হবে, সে ব্যাপারে ধারণা দিয়েছেন কাতারের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার বিভাগের অধ্যাপক মেহরান কামরাভা। এ অধ্যাপক বলেন, ‘এই অঞ্চলটি আমেরিকান ঘাঁটিতে পরিপূর্ণ; এখানে ৪০ হাজারেরও বেশি আমেরিকান সৈন্য রয়েছে। আমি একবার একজন ইরানি কমান্ডারকে বলতে শুনেছিলাম, ‘এর অর্থ হলো, আমরা ৪০ হাজার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারব।’ তাহলে কি ইরানিরা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করবে? এবং যদি তাই হয়, তাহলে কি তারা ‘পরিমিত’ উপায়ে তা করবে, যেমন ২০২০ সালে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধমূলক হামলা করেছিলেন। সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। কামরাভা আরও বলেন, ‘আমি মনে করি এখনও অনেক কিছু দেখার বাকি। তবে ইরানিদের প্রতিশোধ নিতে হবে। রাজনৈতিকভাবে, তারা কেবল চুপ করে বসে থাকতে পারে না এবং ট্রাম্প যেভাবে চান সেভাবে এটি চলতে দিতে পারে না।’

পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ হবে না- ইরান : মার্কিন হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইরানের পারমাণবিক সংস্থা। এক বিবৃতিতে সংস্থা বলেছে, ‘শনিবার দিবাগত রাতে ফোরদো, নাতান্জ ও ইসফাহানের স্থাপনাগুলোতে শত্রুর বর্বরোচিত হামলা আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি বা এনপিটি-র সরাসরি লঙ্ঘন।’ তারা বলেছেন, ‘এই হামলা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-র নিষ্ক্রিয়তায় সংঘটিত হয়েছে, যা নিন্দনীয়।’ বিবৃতিতে বলা হয়, এই স্থাপনাগুলো আইএইএ-র পর্যবেক্ষণাধীন ছিল এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই এ হামলার দায় স্বীকার করেছেন, যা আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। সংস্থাটি জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ‘বিশ্ব সম্প্রদায় যেন ‘আদিম যুগের’ আইনে ফিরে যাওয়াকে প্রতিহত করে এবং ইরানের ন্যায্য অধিকার সমর্থন করে।’ ইরানের পারমাণবিক সংস্থা আরও জানায়, ‘শত্রুর ষড়যন্ত্রের পরও দেশের হাজার হাজার বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞের প্রচেষ্টায় জাতীয় উন্নয়নের এই পথ বন্ধ হবে না। ইরান তার আইনগত অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরআইবি জানিয়েছে, হামলায় ফোরদো স্থাপনার প্রবেশদ্বার ও বহির্গমন গেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গণমাধ্যমটি আরও জানায়, ইরানের কাশান ও ইসফাহানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, যেখানে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর চারপাশে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছিল। এদিকে ক্বোম প্রদেশের মুখপাত্র মর্তেজা হেইদারি বলেন, ‘শত্রুপক্ষ ফোরদোর অংশবিশেষে সফলভাবে আঘাত হেনেছে।’ তবে মার্কিন হামলার আগেই পারমাণবিক স্থাপনাগুলো খালি করা হয় জানিয়ে আইআরআইবি-র রাজনৈতিক উপপরিচালক বলেন, ‘তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা হামলার অনেক আগেই খালি করা হয়েছিল।’

এ হামলার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের অভ্যন্তরে পারমাণবিক স্থাপনায় সামরিক পদক্ষেপ নিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে মধ্যপ্রাচ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনা তীব্রতর হলো এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়তে পারে। ইরানের হামলার প্রতি সর্বপ্রথম মার্কিন পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে চার দেশ- কিউবা, চিলি, মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলা।

যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, শুরু হলো- হুথি : ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মাধ্যমে বড় যুদ্ধের শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহ আন্দোলন। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। হুতিদের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য মোহাম্মদ আল-ফারাহ বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, বরং এটি বড় যুদ্ধের সূচনা। তিনি বলেন, ট্রাম্প যুদ্ধের সমাপ্তি চাননি; সূচনা চেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার সময় এখন শেষ। এর আগে গাজাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লোহিত সাগর, আরব সাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে টানা হামলা চালিয়েছেন হুথিরা। তাদের হামলায় লোহিত সাগর থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় একাধিক মার্কিন বিমানবাহী রণতরী।

মার্কিন হামলা বিপজ্জনক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ- জাতিসংঘ : জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইরানে মার্কিন হামলাকে ‘বিপজ্জনক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এ হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আন্তোনিও গুতেরেস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘আজ ইরানের ওপর মার্কিন বলপ্রয়োগের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আগে থেকেই সংঘাতে লিপ্ত অঞ্চলটিতে এ হামলা বিপজ্জনক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি।’ মহাসচিব আরও বলেন, ‘এ সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এর ভয়ানক পরিণতি বেসামরিক মানুষ, পুরো অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছি। তাদের জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

‘অসাধারণ সামরিক সাফল্য’ বললেন ট্রাম্প : হামলার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানে হামলাকে ‘অসাধারণ সামরিক সাফল্য’ বলে দাবি করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় সময় শনিবার রাত ১০টায় হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এ ভাষণে ট্রাম্প বলেন, ইরানকে এখনই শান্তি স্থাপন করতে হবে। যদি সেটা না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় হামলা হবে। ট্রাম্প বলেন, ‘আজ রাতে, আমি বিশ্বকে জানাতে পারি, ইরানে হামলা ছিল অসাধারণ সামরিক সাফল্য। এ হামলার উদ্দেশ্য ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা শেষ করে দেওয়া। সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে বিশ্বের এক নম্বরে থাকা দেশটির পারমাণবিক হুমকি থামিয়ে দেওয়া।’ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, তিনি ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী দল হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী বিবি নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাতে চাই। আমরা এমন একটি দল হিসেবে কাজ করেছি, যা সম্ভবত আগে কখনও কোনো দল করেনি। আমরা ইসরায়েলের এই ভয়াবহ হুমকি মুছে ফেলতে অনেক দূর এগিয়েছি।’ ট্রাম্প আরও বলেন, আমি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে তাদের অসাধারণ কাজের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই।

ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানালেন নেতানিয়াহু : ইরানে মার্কিন বোমারু বিমানগুলো হামলা চালানোর পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হোয়াইট হাউসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার বরাতে এ খবর জানিয়েছে বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজ। ওই কর্মকর্তা সিবিএস নিউজকে জানান, ইরানে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। পরে এক ভিডিও বার্তায় নেতানিয়াহু ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের জন্য ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, এই হামলা ‘ইতিহাস বদলে দেবে’। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অভিনন্দন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের অসাধারণ আর ন্যায়নিষ্ঠ শক্তি দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়ে আপনার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ইতিহাসকে বদলে দেবে।’ এদিকে নাম উল্লেখ না করে একজন সামরিক কর্মকর্তার বরাতে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কান জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার সময় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণ সমন্বয় করেছে।

হামলার সমালোচনা মার্কিন আইনপ্রণেতাদের : ইরানে ট্রাম্পের হামলার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা। অনেক আইনপ্রণেতা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেছেন। তার দল রিপাবলিকান সিনেটরদের অনেকে এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। যেমন কেন্টাকির সেনেটর টমাস ম্যাসি হামলার সিদ্ধান্তকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ‘এই মাত্র যে খবরটা শুনলাম, যেটা আপনারাও শুনলেন, সেটা শুধু উদ্বেগজনকই নয়; বরং চরমভাবে সংবিধানবিরোধী।’ স্যান্ডার্স বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, এ দেশকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কেবল মার্কিন কংগ্রেসের আছে। প্রেসিডেন্টের সেই অধিকার নেই।’ ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাটিক প্রতিনিধি সারা জ্যাকবস পোস্ট করেছেন, এ হামলা ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি ভয়াবহ ও দীর্ঘ’ যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে। এক বিবৃতিতে কংগ্রেসওমেন রাশিদা তালিব বলেন, ‘আমেরিকান জনগণ আর কোনো চিরস্থায়ী যুদ্ধ চায় না। আমরা দেখেছি, মধ্যপ্রাচ্যে দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধ আমাদের কী অবস্থা করেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই যুদ্ধগুলো মিথ্যা তথ্যের ওপর দাঁড়ানো। যেমন, ইরাকের ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের মতো মিথ্যা প্রচারণা। এবারও একই কৌশল ইরানকে ঘিরে প্রয়োগ করা হচ্ছে।’ তালিব অভিযোগ করেন, ‘ট্রাম্প আমেরিকানদের কথা শোনার বদলে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতানিয়াহুর কথা শুনছেন। যিনি ইরাক নিয়ে মিথ্যা বলেছিলেন, এখন আবার ইরান নিয়ে বলছেন।’ তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকাণ্ডকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যা দেন এবং বলেন, এখনই কংগ্রেসকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, নিজেদের যুদ্ধ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে এবং এই বেআইনি যুদ্ধ থামাতে হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইরানে হামলা সংক্রান্ত ট্রাম্পের পোস্ট শেয়ার করলেও এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেননি।

ইরান পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকে আইএইএ : আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক জেনারেল রাফায়েল গ্রোসি জানিয়েছেন, ইরানে জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় আজ সোমবার আইএইএ-এর বোর্ড অফ গভর্নররা জরুরি বৈঠকে বসবেন। গতকাল সামাজিকমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা জানান। এর আগে আইএইএ বলেছে, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর পরও ‘আশপাশের এলাকায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধির’ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

মার্কিন হামলায় গভীর উদ্বেগ সৌদি আরবের : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন বিমান হামলার ঘটনায় প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরব ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানায়, ‘বন্ধুপ্রতীম ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে, বিশেষ করে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনাপ্রবাহ সৌদি আরব গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে।’ রিয়াদ উত্তেজনা প্রশমন ও আরও সংঘাত এড়াতে সহনশীলতা অবলম্বন এবং উত্তেজনা প্রশমনে প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত