যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক প্রতিশোধমূলক হামলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ইরান। এ লক্ষ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি। গতকাল সোমবার মস্কোয় পুতিনের সঙ্গে আরাকচির বৈঠক হয়েছে।
বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তার দেশ ইরানের জনগণকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। ইরানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে আগ্রাসন চালানো হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ সময় আরাকচি ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার নিন্দা জানানোর জন্য পুতিনকে ধন্যবাদ জানান। আরাকচি বলেন, রাশিয়া ‘ইতিহাসের সঠিক পক্ষে’ রয়েছে। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ও প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শুভেচ্ছা পুতিনকে পৌঁছে দেন। এর আগে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে মার্কিন হামলাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে মস্কো। রাশিয়া বলেছে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডকে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়। হামলার পেছনে যে যুক্তিই উপস্থাপন করা হোক না কেন, তা আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। চীন ও পাকিস্তানের সুরও একই। দৃশ্যত, চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান মিলে মার্কিন আগ্রাসনের জোরালো প্রতিক্রিয়ায় ইরানকে রসদ জোগাচ্ছে।
‘মার্কিন হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার তেহরানের আছে’: মস্কো যাত্রার আগে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার তেহরানের আছে বলে জানিয়েছেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাছাড়া পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিণতির পুরো দায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। রোববার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ওআইসির বৈঠকের সাইডলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে সব আন্তর্জাতিক নিয়ম ও বিধি লঙ্ঘন করেছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, এ ধরনের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের ভয়াবহ পরিণতির জন্য আমেরিকাকে সম্পূর্ণ দায় স্বীকার করতে হবে। জাতিসংঘ সনদের অধীনে ইরানের আত্মরক্ষার অধিকার তুলে ধরে আরাকচি বলেন, মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়া জানাতে তেহরান একাধিক উপায় গ্রহণের অধিকার রাখে। ইরান কখনও সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার সঙ্গে আপস করবে না উল্লেখ করে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তেহরান আত্মরক্ষার জন্য ‘সম্ভাব্য সব প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং সমাধান’ ব্যবহার করবে। তাছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধ হলেই শুধু তেহরান কূটনৈতিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান আরাকচি।
ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন সময় তার দেশের কঠোর অবস্থানের আভাস দিলেন, যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শাস্তি অব্যাহত থাকবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তেহরানে মার্কিন হামলার পর সামাজিকমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ইহুদিবাদী শত্রু একটি বড় ভুল করেছে, একটি বড় অপরাধ করেছে; তাকে শাস্তি দিতে হবে এবং এখন তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।’
ইসরায়েলে দীর্ঘতম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন বহু শহর : ইসরায়েলের সেনাবাহিনী গতকাল সোমবার দুপুরে বলেছে, গত কয়েক ঘণ্টায় ইসরায়েলের বিভিন্ন জায়গায় আটটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ কোম্পানির কৌশলগত স্থাপনার কাছে একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। এতে ওই এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। টাইমস অব ইসরায়েলের খবর বলছে, দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহে গোলযোগ দেখা দিয়েছে। ইসরায়েল ইলেকট্রিক করপোরেশন বলছে, বিদ্যুৎব্যবস্থা স্বাভাবিক করার কাজ চলছে। অবকাঠামো মেরামত ও ঝুঁকিপূর্ণ সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তাবাহিনীও সেখানে কাজ করে যাচ্ছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ইরানের হামলার সময় প্রায় ৩৫ মিনিট ধরে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে সাইরেন বেজেছে। সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল থার্টিনের খবর বলছে, ১৩ জুন হামলা শুরুর পর থেকে এদিন সবচেয়ে লম্বা সময় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়েছে ইসরায়েলিদের। ইসরায়েলের সাবেক বিচারমন্ত্রী জোসি বেইলিন বলেছেন, গতকাল সোমবার ইসরায়েলে সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে হামলা চালিয়েছে ইরান। তেলআবিব থেকে আলজাজিরাকে বেইলিন বলেন, হামলায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেইলিন আরও বলেন, ‘দিনের বেলায় হামলা হয়েছে। সাধারণত হামলাগুলো রাতে ঘটে থাকে।’ ইসরায়েলের সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, আমাদের সামরিক বাহিনী স্পষ্টতই ড্রোনের (ইরান থেকে উড়ে আসা) একাংশ অকার্যকর করেছে। কিন্তু এরপরও এটা নিশ্চিত যে, ইরানিদের কাছে প্রতিদিন হামলা করার মতো যথেষ্ট ড্রোন আছে।
মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা : ইরান-ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের মধ্যে এবার সিরিয়ায় একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মর্টার হামলা হয়েছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাসাকাহ প্রদেশের কাসরুক এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। গতকাল সোমবার ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসরুক অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে হঠাৎ করে মর্টার হামলা চালানো হয়। তবে এ হামলা কে করেছে, হামলার ধরন বা এতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
‘যুক্তরাষ্ট্রকে অপ্রত্যাশিত পরিণতি ভোগ করতে হবে’ : ইরানের অভিজাত ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কোর বা আইআরজিসি’র মুখপাত্র ইব্রাহিম জোলফাঘারি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে ঢুকে গেছে এবং ইরানের ভূমির পবিত্রতা নষ্ট করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে এই মুখপাত্র আরও বলেন, এখন ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান চালানো হবে।’ ইব্রাহিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘জোরালো, দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত পরিণতি’ ভোগ করতে হবে। ইব্রাহিম বলেন, ‘মি. ট্রাম্প, আপনি জুয়াড়ি! আপনি এ যুদ্ধ শুরু করতে পারেন, কিন্তু আমরাই এটি শেষ করব!’
যুক্তরাষ্ট্রকে কল্পনাতীত জবাব দেওয়া হবে- আইআরজিসি : আইআরজিসি অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেছে, মার্কিন আগ্রাসনের এমন জবাব দেওয়া হবে, যা তারা কখনও কল্পনা করেনি। এক বিবৃতিতে রোববার আইআরজিসি বলেছে, ইহুদিবাদী সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় হামলা চালিয়েছে। এই পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন, এনপিটি চুক্তি এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধার মৌলিক নীতিগুলোর স্পষ্ট লঙ্ঘন। বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই ইসরায়েলি আগ্রাসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যাপক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে। কিন্তু, সর্বশেষ কাপুরুষোচিত হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, তার অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিবৃতিতে আইআরজিসি মনে করিয়ে দিয়েছে, এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ব্যাপক উপস্থিতি তাদের শক্তির লক্ষণ নয়, বরং দুর্বলতার উৎস। তাদের সংখ্যা এবং বিস্তৃতি তাদের ঝুঁকিগুলোকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিবৃতিতে আইআরজিসি বলেছে, মার্কিন শাসকগোষ্ঠী আগের যুদ্ধগুলো থেকে কোনো শিক্ষাই নেয়নি। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে নিজেদেরই পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আইআরজিসি বলেছে, ইরানে বিমান হামলায় অংশ নেওয়া সব মার্কিন যুদ্ধবিমানের ফ্লাইট লোকেশন শনাক্ত ও নজরদারিতে রয়েছে। ইরানি বাহিনীর ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্র শুধু কৌশলগত ব্যর্থতাই দেখাচ্ছে না, বরং তারা বাস্তবতা অস্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন যুদ্ধাবস্থা তৈরি করছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এই হুঁশিয়ারি ইঙ্গিত দিচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য অবস্থানরত মার্কিন বাহিনী বর্তমানে ইরান ও তার মিত্রদের সম্ভাব্য পাল্টাহামলার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
ইরানি গণমাধ্যমে হার্মিস ড্রোন ভূপাতিত করার ফুটেজ : ইসরায়েলি হার্মিস ৯০০ ড্রোন ভূপাতিত করার ফুটেজ প্রকাশ করেছে ইরানের গণমাধ্যম। ইরানের সেনাবাহিনী গতকাল সোমবার ভোরে সেগুলো ভূপাতিত করেছে বলে জানিয়েছে। দ্য লরেস্টান সংবাদ সংস্থা টেলিগ্রাম পোস্টে জানিয়েছে, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের অভিযানে ওই ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। লরেস্টান প্রদেশের খোররামাবাদে ওই অভিযান চালানো হয়।
ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় আবার ইসরায়েলের হামলা : ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় আবার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির কোম প্রদেশের সংকটকালীন ব্যবস্থাপনা বিভাগের সদর দপ্তরের মুখপাত্র মোর্তজা হায়দারি আধা সরকারি তাসনিম সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার একদিন পর গতকাল সোমবার সেখানে ইসরায়েলও হামলা চালাল। ইসরায়েলি হামলার কারণে ওই এলাকায় বাসিন্দাদের আপাতত কোনো বিপদ নেই বলেও তাসনিমকে জানিয়েছেন মোর্তেজা হায়দারি। ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক গভীরে অবস্থিত। সেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সেন্ট্রিফিউজ রাখা ছিল। যদিও রোববার ইরানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, অস্ত্র তৈরির উপযোগী মানের কাছাকাছি ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে একটি অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
‘নেতানিয়াহুর চাপেই ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র’ : যুক্তরাষ্ট্র একটি বানোয়াট ও অযৌক্তিক অজুহাতে ইরানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ চাপিয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি। রোববার জাতিসংঘ সদর দফতরে নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ডাকা জরুরি বৈঠকে তিনি বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্পষ্ট আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার রাখে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চাপেই যুক্তরাষ্ট্র ‘অযথা ও ব্যয়বহুল’ যুদ্ধে জড়িয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ইরানি প্রতিনিধি। তিনি জানান, ইরানের পক্ষ থেকে ‘যথাযথ জবাব কখন, কীভাবে এবং কতটা দেওয়া হবে’ তা দেশটির সশস্ত্র বাহিনী ঠিক করবে। ইরাভানি আরও বলেন, ইসরায়েল এক ‘মিথ্যা ও প্রতারণামূলক গল্প’ ছড়িয়েছে যে, ইরান ‘পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দ্বারপ্রান্তে’। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কিছু পশ্চিমা দেশ যেমন ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নীরবতা, দ্বিচারিতা ও সহযোগিতা সমানভাবে নিন্দনীয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে সম্পূর্ণভাবে জবাবদিহির আওতায় আনে, এই আহ্বান জানান তিনি।
হরমুজ প্রণালী বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন ইরানি পার্লামেন্টে : স্পষ্টত কঠোর পথে হাঁটছে ইরান। বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তেহরান। দেশটির পার্লামেন্টের ভোটে এরইমধ্যে এই প্রণালী বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। এখন কেবল এ বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। রয়টার্স জানায়, ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধের এই তোড়জোড়ের মধ্যেই দেশটিকে এই পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে চীনকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালী দিয়েই পরিবহন করা হয়। সিদ্ধান্তটি যদিও এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তবে পার্লামেন্ট সদস্য ও ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর কমান্ডার ইসমাইল কোসারি রোববার ইয়াং জার্নালিস্ট ক্লাবকে বলেছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধের বিষয়টি এখন আলোচ্যসূচিতে রয়েছে। প্রয়োজন হলেই তা কার্যকর করা হবে। এদিকে, হরমুজ প্রণালী বন্ধের বিষয়টি পার্লামেন্টে অনুমোদের খবর ইরানের প্রেস টিভিতে আসার পর এই জলপথ যাতে বন্ধ না হয়, সেজন্য চীনকে তাগাদা দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোববার ফক্স নিউজে এক প্রোগ্রামে তিনি বলেন, ‘আমি চীন সরকারকে উৎসাহিত করব যাতে তারা ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কারণ, তারা তেলের জন্য হরমুজ প্রণালীর ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল।’ তবে রুবিওর বক্তব্যের বিষয়ে ওয়াশিংটনের চীনা দূতাবাস থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। আল-মায়াদিনের খবরে বলা হয়, ইরানের সিনিয়র আইনপ্রণেতারা হরমুজ প্রণালী বন্ধের পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি বা এনপিটি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সম্ভাবনা কথা জানিয়েছেন। এর আগে মার্কিন হামলার পর ইরানি কর্মকর্তারা বলেছেন, এই হামলার মাধ্যমে এনপিটি থেকে ইরানের বের হয়ে যাওয়ার এবং পরমাণু কর্মসূচি পুরোদমে চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা তৈরি হলো।
হরমুজ প্রণালি থেকে দিক পরিবর্তন করছে জাহাজগুলো : মার্কিন সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ইরানে মার্কিন হামলার পর হরমুজ প্রণালি এড়িয়ে চলছে তেলবাহী ট্যাংকারগুলো। এরই মধ্যে হরমুজ প্রণালি থেকে দিক পরিবর্তন করেছে দুটি বিশাল তেলবাহী জাহাজ- কোসইউসডম লেক ও সাউথ লয়্যালটি। জাহাজ দুটি প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল করে অপরিশোধিত তেল পরিবহনের সক্ষমতা রাখে। ব্লুমবার্গ বলেছে, রোববার জাহাজ দুটি হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করেছিল। পরে স্যাটেলাইট ট্র্যাকিংয়ে দেখা যায়, তারা হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে প্রণালি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানি পদক্ষেপের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেল বা পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যয়বহুল নতুন রুট বেছে নেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু হতে পারে- এই ঘটনা সেই সম্ভাবনারই ইঙ্গিত হতে পারে।
বহুমুখী ওয়ারহেডসম্পন্ন খাইবার-শেকান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার : ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের ২০তম হামলায় একাধিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম অত্যাধুনিক খাইবার-শেকান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার কথা জানিয়েছে। রোববার অপারেশন ট্রু প্রোমিজ-থ্রি-র ২০তম ওয়েভে প্রথমবারের মতো খাইবার-শেকান নামে বহুমুখী-ওয়ারহেড বহনে সক্ষম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ঘোষণা দিয়েছে আইআরজিসি-র জনসংযোগ বিভাগ। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, অভিযানের ২০তম ধাপ শুরু হয়েছে কঠিন ও তরল জ্বালানিবাহী ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মাধ্যমে। এই অভিযানে, আইআরজিসির মহাকাশ নিয়ন্ত্রিত তৃতীয় প্রজন্মের ‘খাইবার-শেকান’ মাল্টিপল-ওয়ারহেড ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে, যা আরও নতুন, বিস্ময়কর, নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম, ধ্বংসাত্মক এবং কার্যকর। এই ধাপে ইসরায়েলের জীবাণু গবেষণা কেন্দ্র, বিকল্প কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র এবং বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দরে গাইডেড মিসাইলগুলো আঘাত হানে, যেগুলো আঘাত করার সময় ওয়ারহেডগুলোকে পরিচালনা করতে সক্ষম এবং বিভিন্ন ধরনের উচ্চণ্ডবিস্ফোরক এবং ধ্বংসাত্মক ওয়ারহেড দিয়ে সজ্জিত। বিবৃতিতে বলা হয়, এই পবিত্র প্রতিরক্ষায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতার প্রধান অংশগুলো এখনও ব্যবহার করা হয়নি।
জোরালো আওয়াজ তোলার আহ্বান উত্তর কোরিয়ার : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, এই হামলা জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান উত্তেজনার জন্য ইসরায়েলের ‘অবিরাম যুদ্ধবাজ পদক্ষেপ ও আঞ্চলিক সম্প্রসারণ’ নীতি দায়ী। পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দেয় এবং উৎসাহিত করে। ওই কর্মকর্তা আলজাজিরাকে বলেছেন, উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সংঘাতপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সর্বসম্মত নিন্দা ও প্রত্যাখ্যানের জোরালো আওয়াজ তোলার আহ্বান জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিনের উষ্ণ সম্পর্ক। সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়নে তাদের মধ্যে সহযোগিতা রয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
দুই সপ্তাহ যুদ্ধ করার সম্বল রয়েছে ইসরায়েলের : মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের ফলে ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থার প্রতিদিন প্রায় কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপ এড়াতে ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদরা দ্রুত এই সংঘাতের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুসারে, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাসিক খরচ কমপক্ষে ১২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, যুদ্ধ যদি দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে আর্থিক এবং কাঠামোগত চাপ নিয়ন্ত্রণ করা ইসরায়েলের পক্ষে সম্ভব হবে না। এদিকে, ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দৈনিক খরচ এবং যুদ্ধের মোট খরচ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ দিনে ইসরায়েল ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য কমপক্ষে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং যুদ্ধে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এই পরিসংখ্যানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ক্ষয়ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত নয়। এখনই যুদ্ধের লাগাম ধরার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞরা।
সারাবিশ্বে মার্কিনিদের সতর্ক থাকতে বলল ওয়াশিংটন : নিজেদের নাগরিকদের জন্য বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় রোববার দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণ ব্যাহত হচ্ছে এবং অঞ্চলটির আকাশসীমা কখনও কখনও বন্ধ রাখা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী বিক্ষোভের আশঙ্কা রয়েছে।’ সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ দিয়েছে, মার্কিন নাগরিকরা যেন ভ্রমণের আগে সংশ্লিষ্ট দেশের তথ্য ও সাম্প্রতিক নিরাপত্তা সতর্কতাগুলো মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেখে নেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ এরইমধ্যে নিজ দেশেও ‘উচ্চমাত্রার হুমকি পরিস্থিতি’ সম্পর্কে সতর্কতা জারি করেছে। তারা জানিয়েছে, ইরানে মার্কিন হামলার পর থেকে সাইবার হামলা ও একক হামলার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে।