সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। ২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। ঘটনার একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
জুলাই শহিদ আবু সাঈদের কথা: মৃত্যুর একদিন আগে ১৫ জুলাই দুপুর ১২টা ৩৭ মিনিটে শহীদ ড. শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন আবু সাঈদ। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার উক্তি ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এর পর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে’- উক্তি পোস্ট করেন তিনি। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর ওই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। এই প্রজন্মে যারা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। নায্যদাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সাথে সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।’ ‘অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের’- লেখেন তিনি। এর আগে, সকাল ৯টা ৫ মিনিটে আরেকটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। তার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখা যায়, ওই পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আদনান আবিরকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘যদি আজ শহীদ হই, তবে আমার নিথর দেহটা রাজপথে ফেলে রাখবেন। ছাত্রসমাজ যখন বিজয় মিছিল নিয়ে ঘরে ফিরবে, তখন আমাকেও বিজয়ী ঘোষণা করে দাফন করবেন। একজন পরাজিতের লাশ কখনও তার মা-বাবা গ্রহণ করবে না।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (তৎকালীন রিডার) ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন তিনি।
মর্গে ঢুকে দেখি আমার ভাইয়ের নিথর দেহ : চাচাতো ভাইয়ের স্মৃতিচারণ: আবু সাঈদ আমার জেঠাতো ভাই। আমি ওর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। তবে বড় হলেও একসঙ্গেই আমাদের বেড়ে ওঠা। পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমাদের দুজনের বাবাই বর্গাচাষি। ছোটবেলায় দেখতাম বাবা-জেঠারা অন্যের জমি চাষ করে যে ফসল পেতেন, তার বড় একটা অংশ সার-বীজ কিনে আর জমির মালিকের ভাগ দিতে দিতেই চলে যেত। এ জন্য প্রায় সময়ই তাদের দিনমজুরি খাটতে হতো। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমি আর সাঈদও দিনের পর দিন মাঠে কাজ করেছি। ভোরে উঠে খেতে চলে যেতাম আমরা, সকাল নয়টা পর্যন্ত কাজ করে বাড়ি ফিরতাম। ঘরে যা জুটত, তা-ই মুখে দিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফিরে আবার খেতের কাজে লেগে পড়তাম। খেতে কাজের কারণে আমরা বেশি খেলাধুলার সময়ও পেতাম না। এক পোশাকে ২ থেকে ৩ বছরও পার করেছি। সেই শৈশব থেকেই জানতাম, আমাদের ভাগ্য বদলের জন্য হাঁড়ভাঙা খাটুনি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। খেয়ে না-খেয়ে হলেও পড়াশোনা করতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে, পরিবারের হাল ধরতে হবে। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে থেকেই পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পায় সাঈদ। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর গ্রামেই একটি টিউশনি জোগাড় করে। টিউশনির ১০০ টাকা আর ওই বৃত্তির টাকা দিয়েই খাতাণ্ডকলম কিনত, পরীক্ষার ফি দিত। আমার বড় ভাই তত দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ভাই বাড়িতে এলেই বইখাতা নিয়ে তার কাছে বসে পড়ত সাঈদ। ইংরেজি পড়ত। অনেক সময় তার পাশে আমিও বসে যেতাম। এসএসসি পাসের পর সাঈদ যখন রংপুর সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়, আমি তখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ি। সাঈদকে শহরের একটি মেসে তুলে দিই। একসময় অর্থের অভাবে ওর পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলে অনেক কষ্টে তার জন্য একটা টিউশনির ব্যবস্থা করি। সেই টিউশনির টাকায় নিজের ব্যয়ভার মেটানোর পাশাপাশি মা-বাবাকেও সহযোগিতা করতে থাকে সাঈদ।
সাঈদের নয় ভাই-বোন। অভাবের কারণে বড় চার ভাই-বোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পার করতে পারেনি। সাঈদের পিঠাপিঠি ভাই আবু হোসেন এইচএসসি পাস করে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। তাই আবু সাঈদকে ঘিরেই ছিল পরিবারের সবার আশা-ভরসা। এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে আবু সাঈদ। প্রথমবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ওর সুযোগ হলো না। ভেঙে পড়ল সাঈদ। রংপুর ছেড়ে গ্রামে চলে গেল। খেতখামারে কাজ করতে থাকল। সিদ্ধান্ত নিল আর পড়াশোনা করবে না। দ্বিতীয়বার ভর্তি প্রস্তুতি নিতে বললাম। কোচিং করার টাকা নেই। বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করল। এবার আর ব্যর্থ হলো না সাঈদ। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেল। বেছে নিল বাড়ির কাছের রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কাকতালীয়ভাবে আমার ইংরেজি বিভাগেই ভর্তি হলো। ভর্তির দিন সাঈদকে সঙ্গে করে ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলাম। সব দাপ্তরিক কাজ শেষ করে দুইজনে আমার মেসে এলাম।
ঘটনার একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, আবু সাঈদের বুক ও পেট ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। লুকোচুরির কিছু নেই। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। সাঈদ নিহত হওয়ার পরদিন ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় একটি মামলা হয়। তবে মামলার এফআইআরে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ নেই। আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের এফআইআর নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যার ভিডিও ফুটেজ বিশ্ববাসী দেখেছে। এখন পুলিশ নিজেদের দায় অন্যদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা আরও নষ্ট হবে।