ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পবিত্র আশুরা আজ

শোকাবহ আশুরা ও কারবালা : উম্মাহর দায়বোধ

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
শোকাবহ আশুরা ও কারবালা : উম্মাহর দায়বোধ

ইরাকে ফোরাতের তীরে কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবারে এজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহিদ হন হিজরি ৬১ সালে। এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে রেখেছে যুগের পর যুগ। ইতিহাসে এর চেয়ে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের নজির থাকলেও নানা কারণে কারবালার শাহাদত সমগ্র উম্মাহর জন্য মর্মস্পর্শী। কারণ, নবীজি চলে যাওয়ার মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তারই কলিজার টুকরা নাতি, যাদের জন্য নামাজে তাশাহুদের পর দরূদে ইবরাহিমীতে আল্লাহর কাছে শান্তি ও বরকতের জন্য দোয়া করা হয়, তাদেরকে নবীজির উম্মতের লোকেরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে; অথচ তখনও নবীজির সান্নিধ্যপ্রাপ্ত অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন। একটি মহল থেকে বলার চেষ্টা করা হয়, ইমাম হোসাইনের শাহাদত দুঃখজনক; কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের জন্য এজিদ দায়ী নয়, বরং ইমাম হোসাইন আবেগ তাড়িত হওয়ার কারণে এমন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন।

দেখার বিষয় হচ্ছে, ইমাম হোসাইনের বয়স তখন ৫০ থেকে ৬০ এর মাঝামাঝি। নবীজির কোলে, মা ফাতেমা ও হজরত আলী (রা) এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছিলেন নবুয়াতী ধারার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে। উম্মাহর আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব তখন তার হাতেই ছিল। যে কারণে তিনি এজিদের মতো পাপিষ্ট শাসকের আনুগত্য স্বীকার করতে পারেন নি। কাজেই তার প্রতিটি চিন্তা ও পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত। মক্কা মুয়াজ্জমায় হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত এড়ানো এবং অপদার্থ শাসকের কবল থেকে খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য রাসূলের নাতি হিসেবে তার সামনে বিকল্প পথ খোলা ছিল না। তিনি পত্রযোগে কুফাবাসীর আহ্বানের উপর নির্ভর করেননি। সরেজমিন রিপোর্ট দেয়ার জন্য চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠিয়েছিলেন দূত হিসেবে। তিনি কুফায় পৌঁছলে কুফাবাসী ইমাম হোসাইনের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ স্বরূপ তার হাতে বায়াত করে। মুসলিম উবনে আকিল পত্রযোগে সে সংবাদ মক্কায় পাঠিয়ে ইমাম হোসাইনকে তাড়াতাড়ি কুফায় চলে আসার অনুরোধ করেন। বিশ্বস্ত দূতের পত্র পেয়ে তিনি মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা হন।

এরইমধ্যে দামেস্কের শাসক এজিদ কুফার গভর্ণরকে অপসারণ করে উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে নতুন গভর্ণর নিযুক্ত করে। ইবনে জিয়াদ ছদ্মবেশে গভর্নর হাউসে প্রবেশ করার পর মসজিদের মিম্বরে বসে কঠোর হুশিয়ারী দিয়ে বক্তব্য রাখে এবং সর্বত্র প্রচণ্ড ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। কুফার তরুণ যুবকরা তখন গভর্নর হাউজ ঘেরাও করে ফেলে। ইবনে যিয়াদ নানা কৌশলে কুফার গণ্যমান্য লোকদের গভর্নর হাউসে জড়ো করে আন্দোলনরত যুুবকদের শান্ত করার জন্য বাধ্য করে। ওদিকে মায়েরা এসে ছেলেদের বলতে থাকে, আন্দোলনের জন্য অনেক লোক আছে, তুমি বাচাধন ঘরে এসো। দুয়েকদিনের মধ্যে গভর্নর হাউসের চারপাশের অবরোধ ভেঙে যায়। তারপর শুরু হয় ধরপাকড়, কুফার লোকেরা তখন পল্টি মারে, ইবনে যিয়াদের দিকে ঘুরে যায় তাদের আনুগত্য। মুসলিম ইবনে আকিল এক পর্যায়ে আত্মগোপন করেন। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তাকে ইবনে যিয়াদ বন্দি করে ফাঁসি দেয়। শহিদ হওয়ার আগে তিনি প্রাণপ্রিয় নেতা ইমাম হোসাইনকে কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানিয়ে চিঠি লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মুসলিম ইবনে আকিলের শাহাদত বরণ এবং কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ পেয়ে ইমাম হুসাইন একবার চিন্তা করেন মক্কায় ফিরে যাবেন। কিন্তু মুসলিম ইবনে আকিলের ছেলেরা পিতার রক্তের বদলা নেওয়ার জন্য কুফা যাবার ব্যাপারে আপসহীন মনোভাব দেখায়। ইমাম ভাবতে থাকেন হয়ত দূরের কোনো জনপদে চলে যাবেন। কাফেলা এগিয়ে চলছে। আওয়াজ উঠল ঐ অদূরে জনপদ দৃশ্যমান, খেজুরের শাখাগুলো মরুভুমিতে দৃষ্টিসীমায় জেগে উঠেছে।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, কোনো নিরাপদ জনপদ নয়, বরং ইবনে যিয়াদের পাঠানো সামরিক দল। তারা ইমামের কাফেলাকে ঘিরে ফেলল। তাদেরকে কুফায় নিয়ে যাবে, এ ব্যাপারে অনড়। জোহরের নামাযের সময় হলে ইমাম জিজ্ঞাস করলেন, তোমরা তো শত্রুর ভূমিকায় আমাদের ঘেরাও করে রেখেছ। এখন কি আলাদা জামাতে নামাজ পড়বে। নাকি আমাদের সঙ্গে পড়বে। অধিনায়ক হুর ইবনে ইয়াযীদ জবাব দিল, আপনি রাসূলের নাতি থাকতে আমরা অন্য ইমামের পেছনে ইকতিদা করব না। নামাজ শেষ হলে আবারো তারা কাফেলার উপর অবরোধ আরোপ করল। ধর্মীয় নেতৃত্ব থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিভাজন কীভাবে আসল সে ইতিহাসের একটি ছোট্ট উপমা এটি। কেউ কেউ পরামর্শ দিল, এখনই কম লোকের সাথে যুদ্ধ করে আমরা অন্যদিক চলে যেতে পারি। সামনে তো বিপদ অনেক কঠিন।

ইমাম বললেন, আমি আগে কোনো মুসলমানের উপর আঘাত করতে পারি না। কাফেলা ধীরে ধীরে কুফার কাছে কারাবালা প্রান্তরে উপনীত হল। ওদিকে ইবনে যিয়াদ ইমাম হোসাইনের কাফেলার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিরাট বাহিনী গঠন করে। তখনকার দিনে নিয়মিত সামরিক বাহিনী ছিল না। অবস্থা বুঝে সাধারণ মানুষদের নিয়ে অধিনায়ক নিয়োগ ও বাহিনী গঠন করা হত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ইবনে যিয়াদের এজিদী বাহিনীর অধিনায়ক হলেন মুহাম্মদ ইবনে সাদ। তার মানে কাদেসিয়া বিজয়ী আশরা মুবাশশারার একজন সাদ ইবনে আবি ওক্কাসের ছেলে মুহাম্মদ। তাকে প্রলোভন দেয়া হল, রেই শহরের গভর্ণর বানানো হবে। সেই প্রলোভনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কারবালায় গেলেন। ইমাম তাদেরকে বুঝানোর জন্য সব রকমের চেষ্টা করলেন। ইমামের তিনটি প্রস্তাবের কথা ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। ১. আমাকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। ২. দামেস্কে গিয়ে এজিদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই। কিংবা ৩. অন্য কোনো দূরের মুসলমান লোকালয়ে চলে যেতে চাই। কিন্তু এজিদের হাতে বায়আত ছাড়া আর কিছুতেই তারা রাজি নয়। কোনো পাপিষ্ট লোক খেলাফতের মসনদে বসে দ্বীন ইসলামের ক্ষতি করবে এমন লোকের কাছে আনুগত্যের শপথ বায়আত তো রাসূলের নাতি নিতে পারেন না।

৯ মহররম ইমাম হোসাইন শত্রুবাহিনীর কাছে সময় চেয়ে নিলেন সেই রাতে যেন আক্রমন না করা হয়। এই অবসরে তিনি আল্লাহর কাছে হৃদয়ের সবটুকু আকুতি জানিয়ে কান্নাকাটি করলেন। সঙ্গীদের উদ্দেশে বললেন, এরা শুধু আমার প্রাণ চায়। কাজেই রাতের অন্ধকারে তোমরা দূরের কোনো লোকালয়ে আশ্রয় নিতে পার। আমি তোমাদের বায়আত ফিরিয়ে দিলাম। কিন্তু ইমামকে ছেড়ে যেতে কেউ রাজি হল না। পরদিন ইমাম সুদক্ষ সেনাপতির মতো তাবুগুলো পেছনে রেখে ব্যুহ রচনা করলেন। একে একে আপনজনদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠালেন। মাঝখানে হুর ইবনে ইয়াযীদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইমামের কাফেলায় ছুটে এসে এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহিদ হলেন। ঘোরতর যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইমাম হোসাইন নিজেই শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন।

তার লাশের উপর ঘোড়া দৌড়ানো হল। ইবনে যিয়াদের দরবারে কুফায় তার খণ্ডিত মাথা মোবারকের সঙ্গে বেয়াদবী করা হল। দামেস্কেও এজিদ জাহেলী যুগের দাম্ভিকতা প্রকাশ করল আহলে বাইতের বন্দি কাফেলা ও ইমামের মাথা মোবারক সামনে রেখে। ততক্ষণে জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। প্রচণ্ড ঘৃণা ধুমায়িত হতে থাকে এজিদের রাজত্ব ঘিরে। তখন তড়িঘড়ি আহলে বাইতের বন্দি মহিলাদের মদীনায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই আচরণ থেকে একটি মহল এজিদকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করে। কিন্তু এজিদের সাড়ে তিন বছর রাজত্বের তিনটি ঘটনা সামনে আনলে পরিষ্কার হয়ে যায়, এজিদ কত বড় পাপিষ্ট ছিল। মসনদে বসার প্রথম বছরে সে কারবালায় হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড ঘটায়। দ্বিতীয় বছর হাররার ঘটনায় মদীনা আক্রমণ করে লুটতরাজ ও জেনা ব্যভিচারের সয়লাব বয়ে দেয়, যার ফলে অন্তত তিনদিন মসজিদে নববীতে আজান ও জামাত হয়নি। তৃতীয় বছর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে হত্যা করার জন্য মক্কা আক্রমণ করে এবং মিনজানিক দিয়ে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে কাবাঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, সেই অগ্নিকাণ্ডে কাবাঘরের ছাদে মীযাবে রহমতে রক্ষিত ইসমাঈল (আ.) এর বদলায় জবাইকৃত কুরবানীর পশুর শিংটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

হয়ত ভাবছেন, এত মুসলমান এত এত সাহাবা থাকা সত্ত্বেও কারবালার ঘটনা কীভাবে ঘটল। তাহলে প্রশ্ন, আজ দেড় বছর পর্যন্ত গাজায় আল্লাহর শত্রু ইসরাঈল অসহায় ফিলিস্তিনীদের পিষ্ট করে মারছে, অথচ এই নির্মম হত্যাকাণ্ড রোধ করার জন্য কোনো আরব দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সফরকারী ট্রাম্পের কাছে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না: অথচ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আল্লাহর দেয়া সম্পদ তুলে দিল উপহার হিসেবে। আরবী ললনাদের চুলের দোলন দিয়ে অতিথিকে বরণ করা হল আরব আমিরাতে। দুনিয়ার কোটি কোটি মুসলমান আমরাই বা কতটুকুন কী দায়িত্ব পালন করছি। একমাত্র ইরান রুখে দাঁড়িয়েছে ইসরাঈলী ও পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

আজকের দিনে শিয়া সুন্নী বিরোধের সুযোগ নেই। অতি উৎসাহী যারা কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের আহলে বাইতের অনুসারী ও শিয়া নামে দাবি করতে চায় এবং সুন্নীদের এজিদপন্থি বলে সমালোচনা করতে আনন্দ পায়, তাদেরকে বলব, প্রতারণার ফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক হোন। ইমাম হোসাইনের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের আদর্শিক পরিচয় কী। তারা ছিল শিয়ানে আলী, আলীপন্থি শিয়া। তাদের সমর্থন লাভের আশায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনা হতে কুফায় নিয়ে এসেছিলেন। এরাই ইমাম হাসানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ইমাম হোসাইনকে কুফায় আসার জন্য পত্রের পর পত্র লিখেছিল এরাই। মুসলিম ইবনে আকিলকে তারাই শহিদ করেছিল। এরা বিশ্বাসঘাতক। কারাবালায় এজিদ বাহিনীর সৈন্য তো ছিল তারাই। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের শুরুতে একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘মা আহলে কুফে নিস্তীম ইমাম তানহা বেমানদ’। ‘আমরা কুফাবাসী নই যে, ইমাম নিঃসঙ্গ হয়ে থাকবেন।’ এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই মুখতার সাকাফীর তাওয়াবীন আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।

আজকের দিনের সবচে বড় প্রয়োজন ঐক্য। প্রয়োজন ইরানের পাশে দাঁড়ানো। ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু না পারলে একান্ত মোনাজাত দোয়া করা। আল্লাহ পাক অবশ্যই যুগে যুগে নবী রাসূলদের হত্যাকারী হিংস্র ইহুদিদের গাজায় ক্ষুধায় অবরোধে নারী শিশু মুসলমানদের হত্যাকারীদের শাস্তি দিবেন। তবে আগে আরবের মুনাফিকদের চিহ্নিত করবেন। মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার বলেছেন, ‘কতলে হোসাইন আসল মে মর্গে এজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ’। হোসাইনের মৃত্যুর মধ্যে মূলত এজিদের মরণ নিহিত ছিল। প্রত্যেক কারাবালার পরেই ইসলাম নতুন জীবন লাভ করে। আল্লাহতে বিশ্বাসী হিসেবে আমরা সেদিনের অপেক্ষায়। (৪ জুলাই ঢাকা বায়তুশ শরফ মসজিদে জুমার খুতবাপূর্ব আলোচনার শেষাংশ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত