ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কোটি প্রবাসীর ভোটার হওয়ার স্বপ্ন আটকে আছে সিদ্ধান্তহীনতায়

কোটি প্রবাসীর ভোটার হওয়ার স্বপ্ন আটকে আছে সিদ্ধান্তহীনতায়

দেশের দেড় কোটি রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের মধ্যে এক কোটিরও বেশি ‘পরিচয়হীন’। এদের ভোটার করার জন্য সরকার শত কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলেও গত দুই বছরে এ প্রকল্পে তেমন সুফল পাইনি প্রবাসীরা। এর বড় কারণ সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা। নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিজস্ব জনবল দিয়ে প্রবাসীদের ভোটার করবে, নাকি সরকারের মিশনগুলোর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করবে- এ নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, প্রবাসীদের দ্রুত ভোটার করার জন্য বড় বাধা বিদেশে অবস্থানরত মিশনগুলো। তাদের অনেক সময় অসহযোগিতার কারণে প্রবাসীদের ভোটার করতে দেরি হচ্ছে। এ দায়িত্ব যদি ইসির হাতে থাকত। ইসির জনবল দিয়ে করা হতো, গত দুই বছরে আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম। এখন যা করতে যাই বিদেশি মিশনগুলোর ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। ইসির প্রবাসী শাখা জানায়, বিশ্বের ৪০টি দেশে প্রবাসীদের ভোটার করার লক্ষ্যে সরকার প্রস্তুতি নিয়েছিল। এরই মধ্যে ইসি ৭টি দেশে ১১টি মিশন অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে। এ বছর আমেরিকাণ্ডকানাডাসহ আরও ৪টি দেশে শুরু করবে। এখন পর্যন্ত অনলাইনে ৪২ হাজার অবেদন করেছে। এর মধ্যে মিশন অফিস আপ্রুভ দিয়েছে ১৮ হাজার। বাকিগুলো পেন্ডিং অথবা কান্সেল হয়েছে। আর ভোটার হয়ে ইসির সার্ভারে যুক্ত হয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৫০০ প্রবাসী। জানা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর মেয়াদে ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিয়া) দ্বিতীয় পর্যায়’ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ইসি। প্রকল্পের আওতায় প্রবাসে নিবন্ধন টিম পাঠানো ও বাংলাদেশি নাগরিকদের নিবন্ধন সংক্রান্ত ব্যয় হিসাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু সমন্বয়হীনতায় ঠিকঠাক কাজ করা যায়নি গত সরকারের অমলে।

সূত্র জানায়, গত ২০১৭ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে মুক্ত আলোচনায় প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে তাদের এনআইডির বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, ‘দেশের প্রায় ৯০ লাখ নাগরিক (বর্তমানে ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি) বিশ্বের বিভিন? দেশে কাজ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন এবং দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। বিভিন? কারণে তাদের অনেকে এনআইডি প্রস্তুত করতে পারেননি। এনআইডি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উপস্থিতি আবশ্যক। এটি প্রাপ্তি বা সংশোধনের জন্য প্রবাসীদের বাংলাদেশে আসতে হয়। ফলে তারা ভোগান্তির সম্মুখীন হন। তাই বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান, সশোধন ও স্মার্টকার্ড দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সেসময় প্রস্তাবটি পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন দেন। পরে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসীদের এনআইডি দেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের এনআইডি প্রদান ও ভোটাধিকার সংক্রান্ত একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেখানে রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা তাদের মতামত দেন। পরে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ওয়েবসাইট উদ্বোধনের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এ কার্যক্রম উদ্বোধন হয়। পরে আরো ৫টি দেশে কার্যক্রম শুরু হয়।

যেসব দেশে প্রবাসীদের এনআইডির কার্যক্রম চালু করতে চায় ইসি সেগুলো হলো- প্রবাসীদের এনআইডি দিতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মরিশাস, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাসে কার্যক্রম চালাবে নির্বাচন কমিশন।

এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এনআইডি নিবন্ধন ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি সহজ করতে এবং মাঠপর্যায়ে বিড়ম্বনামুক্ত সেবা দিতে একগুচ্ছ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো- দ্য সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫১ দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেমপোরারি প্রভিশন) অর্ডার, ১৯৭২-এর বিধান অনুসারে যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক, তাদের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ দাখিলের প্রয়োজন নেই। এ আইন ও আদেশ অনুযায়ী আবেদনকারীর পিতা-মাতা অথবা দাদা-দাদির বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র-বাংলাদেশি পাসপোর্ট-ড্রাইভিং লাইসেন্স-অনলাইন জন্মসনদ-অনলাইন মৃত্যুসনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) এবং সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন-পৌরসভা-ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ইস্যুকৃত নাগরিক সনদের কপি দাখিল করতে হবে।

কোনো বাংলাদেশি প্রবাসী অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে ইস্যুকৃত দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তাকেও জাতীয় পরিচয় প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেমপোরারি প্রভিশন) রুলস, ১৯৭৮-এর রুল ৪-এর বিধান অনুযায়ী বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জনকারী বিদেশি নাগরিকের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে ইস্যুকৃত নাগরিক সনদ, বিবাহের প্রমাণপত্র ও স্বামী-স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে।

বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার শর্তে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেন, উক্ত বিষয়টি উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশন ওই ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল করে ভোটার তালিকা থেকে তার নাম কর্তনের জন্য নির্দেশনা দিতে পারবে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের দাখিলকৃত জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির আবেদনসমূহ প্রাপ্তির পর বায়োমেট্রিক তথ্য গ্রহণসহ সাত কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি এবং দুই কার্য দিবসের মধ্যে ডেটা আপলোড নিশ্চিত করতে হবে।

প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান, নাগরিকত্ব আইন, ভোটার তালিকা আইন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন এবং এ-সংক্রান্ত সব বিধিবিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত