গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল বলে জানিয়েছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিশনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে জমা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল। সেগুলো হলো ভুক্তভোগীকে হত্যা। বিচারের আগেই ভুক্তভোগীকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশে বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো। ভুক্তভোগীকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেওয়া।
৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশনপ্রধান বলেন, এই প্রতিবেদনে তাঁরা তুলে ধরেছেন, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও বহু অপরাধী ও তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা রকম ভীতিকর-আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবু বহু ভুক্তভোগী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। দেশীয়-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তাঁরা সে কাহিনি তুলে ধরেছেন। গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব এখন আর অস্বীকার করা যায় না। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা কিছু আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। সেখানে তিনি ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শুনেছেন, যা গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্স) গঠিত হয়। গঠনের কমিশন বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্ত, কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিলেন, তা নির্ধারণে কাজ শুরু করে।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য সারা দেশে মোট ১৬টি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করা হয়েছে বলে কমিশন জানায়। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ছাড়া বিভিন্ন সময় তথ্যপ্রাপ্তির পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান চালানো করা হয়েছে। গুমসংক্রান্ত অভিযোগগুলোর মধ্য থেকে ১৩১টির বিষয়ে আইন মোতাবেক এফআইআর বা জিডি রেকর্ড করে ভুক্তভোগীদের সন্ধান-উদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রায় ১ হাজার ৮৫০ অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানায় কমিশন। কমিশন বলেছে, এ ক্ষেত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, নিখোঁজ হওয়ার সময় ভুক্তভোগীর নিকটাত্মীয়ের করা সাধারণ ডায়েরি, ফৌজদারি মামলা, গুম থাকা অবস্থায় সংবাদ প্রতিবেদনের মতো সমসাময়িক প্রমাণ রয়েছে। শুধু এই ২৫৩ জন সমসাময়িক প্রমাণ দাখিল করতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিরা হননি। কারণ, তখন এসব ক্ষেত্রে জিডি করতে গেলে তা নেওয়া হতো না। দ্বিতীয়ত, গুম অবস্থা থেকে ফেরতের সময় ভুক্তভোগীদের সন্ত্রাসবিরোধী মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোনো একটি সংস্থা স্বীকার করে নেয় যে ব্যক্তিটি তাদের হেফাজতে আছে। তৃতীয়ত, এই ভুক্তভোগীরা জীবিত আছেন, তাই তাঁরা কমিশনকে জানাতে পেরেছেন যে তাঁরা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গোপন আটক কেন্দ্রে বন্দী ছিলেন। যেখানে তাঁদের অনেকের একে অপরের সঙ্গে দেখাও হয়েছে। একই ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। অর্থাৎ এই ২৫৩ ব্যক্তিকে গুম করার মুহূর্তে, গুমকালীন ও গুম থেকে ফেরত আসার মুহূর্তে তিনটি পর্যায়ই অকাট্য প্রমাণাদি পাওয়া যাচ্ছে।
কমিশন প্রধান বলেন, তাঁদের কাছে ২৫৩ জন মানুষের একটি তথ্যভিত্তিক দলিল রয়েছে। যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এমন ঘটনা কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি হাতে গোনা কিছু অবাধ্য কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন অপরাধও হতে পারে না। এই অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য একটি সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত কাঠামোর অস্তিত্ব নির্দেশ করে। এতে স্পষ্ট হয় যে বিগত সরকারের শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ অভিযানের ছায়াতলে ইসলামি উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। যার ভুক্তভোগী ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবী তথা সাধারণ জনগণ। এ প্রক্রিয়ায় তারা ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করেছে। নির্যাতন ও গোপন আটকের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দিয়েছে।
কমিশন জানায়, এই ২৫৩ জনের নমুনা এক দশকের বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত। তাঁদের বয়স, পেশা ও নিখোঁজ থাকার সময়কাল—সবই ভিন্ন হলেও অভিজ্ঞতাগুলো আশ্চর্যজনক প্যাটার্নে মিলে যায়। অধিকাংশই সে সময়ের বিরোধী দলগুলোর বা ভিন্নমতের সমর্থক ছিলেন। তাঁদের অনেকের রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়েই প্রশ্ন করা হয়েছে। এমনকি অল্প কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দলীয় কোন্দল বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে গুম করা হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা প্রায় একই ধরনের প্রক্রিয়ার শিকার—পদ্ধতিগত নির্যাতন, সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার, একই ধরনের আইন অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের ও একই ধরনের ভাষায় বর্ণনা। বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার এই সামঞ্জস্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে। ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় যে একটি ‘জঙ্গিবাদ’ দমন অভিযানে ২-১ জন অসাবধানী কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে গেছে। বরং এটি ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দমনযন্ত্র। যা জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে কমিশন দেখিয়েছে, মামলার সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নয়, বরং রাজনৈতিক ও ‘পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর’ভিত্তিক বিবেচনা কাজ করেছে।
কমিশন জানায়, তাদের কাছে দাখিল করা ৮১ শতাংশ অভিযোগ জীবিত ভুক্তভোগীদের। ১৯ শতাংশ অভিযোগ ফেরত না আসা ভুক্তভোগীদের। এবারের প্রতিবেদনে গুম অবস্থা হতে ফিরে না আসা ১২ জন ভুক্তভোগীর বিষয়ে অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে, যাঁদের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়েছে। তাঁদের গুমের জন্য কারা দায়ী, তা প্রাথমিকভাবে কমিশন শনাক্ত করতে পেরেছে। চলমান অনুসন্ধানের স্বার্থে এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফিরে না আসা ভুক্তভোগীদের আরও অনেকের বিষয়েই কমিশনের কাজের অগ্রগতি রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। কমিশন বলেছে, কিন্তু একেকজন ভুক্তভোগীর বিষয়ে অনুসন্ধান সম্পন্ন করার আগে এ বিষয়ে এ মুহূর্তে তথ্য প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। ফিরে না আসা ভুক্তভোগীদের বিষয়ে অপরাধী এবং গুমের অপরাধ সংঘটনের স্থানসহ নানাবিধ বিষয়ে তথ্যের ঘাটতি, পুরোনো কললিস্ট না পাওয়াসহ নানা রকম বিলম্বঘটিত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে কমিশন। তা সত্ত্বেও কমিশন আন্তরিকতার সঙ্গে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে কমিশন সুনির্দিষ্টভাবে দুটি সুপারিশ দিয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। প্রথমত, সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহারের বিষয়ে অবগত হয়ে সেগুলো ন্যায়বিচারের মানদ- বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান ‘কাউন্টার টেররিজম মেথড’ ত্রুটিপূর্ণ বিধায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো উপযুক্ত ‘কাউন্টার টেররিজম মেথড’ বের করা।
কমিশনপ্রধান বলেন, সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে হামলার মতো ঘটনা এর প্রমাণ। তবে এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি ও আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।